গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে ভোট বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এখন থেকে সে ক্ষমতা বারবার প্রয়োগ করা হবে।
কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতিতে ভোট বাতিল হলে ভোটে কারচুপির চেষ্টা থেমে যেতে বাধ্য বলে মনে করছেন নির্বাচন কমিশনাররা।
পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।
তারা বলছেন, ভোটে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে যে মামলাগুলো হয়, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতেও যেনতেন উপায়ে ভোটে জিতে আসার প্রবণতা কমবে।
নির্বাচনে কারচুপি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জাল ভোট, ভোট দিতে বাধাদানের বিষয়টি নতুন নয়। প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই এই ঘটনাটি ঘটেছে। যদিও ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অভিযোগগুলো এসেছে খুবই কম, তবে বিশেষ করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এর পরের ভোটগুলোতে বারবার আসতে থাকে অভিযোগ।
প্রতিবার ভোটের সময় কেন্দ্র দখল করে সিল বা বিরোধীপক্ষকে বাধাদানের অভিযোগগুলো আসার পর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা’ উল্লেখ করা হয়েছে, তবে গত ১২ অক্টোবর কমিশনের অবস্থান ছিল পুরো বিপরীত।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এখন পর্যন্ত যতগুলো ভোট হয়েছে, তার মধ্যে গাইবান্ধার নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক উঠতে পারত, তবে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঢাকায় দেখে নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্তে সে বিতর্ক আর ওঠেনি।
ক্যামেরায় দেখা যায়, ইভিএমে আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি গোপন কক্ষে গিয়ে তার ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারছিলেন না। একাধিক কেন্দ্রে দেখা যায়, সেখানে উপস্থিত থাকা অননুমোদিত ব্যক্তি তার হয়ে ভোট দিয়েছেন বা তাকে প্রভাবিত করে ভোট দিয়েছেন।
একে একে ৫১ কেন্দ্রে ভোট বাতিলের পর নির্বাচন কমিশন একপর্যায়ে নির্বাচনই বন্ধ করে দেয়, যা এর আগে কখনও ঘটেনি।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাবেকদের সঙ্গে বর্তমান কমিশন যে আলোচনা করেছে, সেখানে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই ক্ষমতা প্রয়োগ বারবার করা উচিত।
তার মতে, ১৯৯৪ সালে মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনে যদি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা হতো, তাহলে দেশের রাজনীতিই পাল্টে যেত।
এ ক্ষমতা বারবার প্রয়োগ করা উচিত উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তাহলে কিন্তু জাতির কাছে অন্য রকম একটা মেসেজ (বার্তা) যাবে যে আপনারা এটুকু দেখানোর জন্য করলেন। বাকিগুলো করলেন না।’
নির্বাচন কমিশন আসলে কী ভাবছে জানতে চাইলে কমিশনার আনিছুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অবশ্যই। যেখানে অনিয়ম দেখব, সেখানেই এভাবে ভোট বন্ধ করে দেব। অনিয়ম করলেই ভোট বন্ধ করা হবে। মানুষ যাতে বুঝতে পারে অনিয়ম করলে কোনো পার পাওয়া যায় না। এর থেকে আমরা বিচ্যুত হব না।’
আরেক নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘সামনে যাতে এগুলো (ভোটে কারচুপি) না হয়, সে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ রকম যদি অনিয়ম হয় তাহলে নিয়ম অনুযায়ী যা হওয়ার তাই হবে।’
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভোট বন্ধের ধারাবাহিকতা উনারা যদি বজায় রাখতে পারেন, এটা অবশ্যই ভালো। গাইবান্ধা তো একটা সিট। ৩০০ আসনে করতে পারবে কি না, সেটা চিন্তার বিষয়, তবে অনিয়মে ভোট বন্ধ করছে। এটা তো অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, ভোট বন্ধ করা নির্বাচন কমিশনের মূল্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তাদের দায়িত্ব ভোট করা। অনিয়ম যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা।’
এই দুই পর্যবেক্ষকেই জোর দিয়েছেন ভোটে কারচুপির মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে।
বদিউল বলেন, ‘গেজেট হওয়ার আগেই কমিশনের এসব বিষয়ে প্রতিকার করা উচিত।’
অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ভোটে অনিয়মের অভিযোগে মামলাগুলো পাঁচ বছরেও নিষ্পত্তি হয় না। ট্রাইব্যুনাল রায় দিলেও উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশের সুযোগে জনপ্রতিনিধিরা তাদের মেয়াদকাল শেষ করেছেন।
১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মামলা করে জিতেছিলেন। এরপর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ভোলা-৩ আসনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী জসিম উদ্দিন তার সংসদ সদস্য পদ হারান। সেখানে উপনির্বাচন হলে তিনি মনোনয়নও পাননি। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন জিতে সংসদ সদস্য হন।
একই নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৫ আসন থেকে মহাজোটের মনোনয়নে জয়ী জাতীয় পার্টির আবুল কাশেমের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সেই নির্বাচনে তার অর্ধেক ভোট পেয়ে পরাজিত বিএনপির মাহমুদুল হাসান নেই আসনের সংসদ সদস্য হন।
ভোটে কারচুপির অভিযোগে সংসদ সদস্য পদ খারিজের আদেশের পরও উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশের সুযোগে মেয়াদ শেষ করেন ২০০১ সালে পিরোজপুরের একটি আসন থেকে নির্বাচিত জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ২০০৮ সালে চাঁদপুর থেকে নির্বাচিত মহিউদ্দীন খান আলমগীর।
মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় এরপর জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা সেভাবে মামলা করতেও আর আগ্রহ পান না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরাজিত জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে মামলা করার ঘোষণা দেয়া হলেও পরে আর সেই মামলা হয়নি।
ব্রতীর শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘এখন মামলা খুব একটা হয় না। ২০০৮ সালে কিছু লিগ্যাল অ্যাকশন হয়েছিল।’
এর কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের ইচ্ছার ঘাটতি আছে। নির্বাচন কমিশনকে চাইতে হবে। এটা অন্যায় প্রতিহত করার একটা মাধ্যম হবে।’