বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাসচালক জামিরের ‘সোশ্যাল ক্রসফায়ার’ দেখলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

  •    
  • ২৫ অক্টোবর, ২০২২ ২১:০৭

তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরদের মাইক্রোবাসের সঙ্গে জামির হোসেনের বাসের সংঘর্ষ নিয়ে ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ডক্যুফিল্ম ‘সোশ্যাল ক্রসফায়ার’। এর প্রিমিয়ারে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার মামলায় বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান বাসচালক জামির হোসেন।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তির আগেই কারাবন্দি অবস্থায় ২০২০ সালের ১ আগস্ট মারা যান জামির। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার সময়ে ঈদের দিন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, পরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানান।

দুর্ঘটনার জন্য বিচারিক আদালতে জামির দোষী সাব্যস্ত হলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, বাসচালক জামির ছিলেন ‘নির্দোষ’।

অধ্যাপক ড. সামছুল হকের সে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নির্মাণ হয়েছে ডক্যুফিল্ম ‘স্যোশাল ক্রসফায়ার’। আজহারুল ইসলাম অভি পরিচালিত ডক্যুফিল্মটির প্রযোজক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান আলী। সহকারী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন মো. সেলিম।

এই ডক্যুফিল্মের প্রিমিয়ারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, অধ্যাপক সামছুল হকের অনুসন্ধানে পরিষ্কার হয়েছে, দুর্ঘটনায় বাসচালক জামির হোসেন ছিলেন নির্দোষ।

জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে মঙ্গলবার ডক্যুফিল্মটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। আয়োজকেরা বলছেন, সারা দেশে প্রদর্শন করা হবে এটি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ছবি: সংগৃহীত

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর ঘটনায় সারাদেশের মানুষ কষ্ট পেয়েছিলেন। সেদিন সবাই বলেছিলেন, এই অকালমৃত্যু কাম্য নয়। এ ঘটনার সুনিশ্চিতভাবেই তদন্ত হওয়া দরকার। আমরাও সে ধরনের একটা তদন্ত চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিকে সামনে আনা হোক।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আজকে কিন্তু সেই ক্ষণটি আমাদের সামনে এসেছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক গবেষণার মাধ্যমে সত্যটি উদ্ঘাটন করেছেন। আজকে স্যোশাল ক্রসফায়ার নামের ডক্যুমেন্টারিটি দেখে আমরা সবাই অভিভূত। এ জন্য তাকে (ড. সামছুল হক) ধন্যবাদ জানাই, স্যালুট জানাই। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন, ওই দুর্ঘটনার জন্য বাসচালকের ততখানি ভূমিকা ছিল না।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাসচালক জামিরের যে দোষ নেই, সেটা আমি শুনেছিলাম। আজকে সেটা দেখে গেলাম।’

সরেজমিন অনুসন্ধান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ড. সামছুল হক বলছেন, সেদিন রাস্তায় সঠিক লেনেই ছিল জামিরের বাস। একটি বাঁকের মুখে তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি আকস্মিকভাবে ভুল লেনে চলে আসার কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা জামিরের বাসটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।

বিচারিক আদালতে ওই দুর্ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু ত্রুটি ঘটেছিল বলেও মনে করেন অধ্যাপক সামছুল হক।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সাধারণত দুর্ঘটনা হলেই আমরা চালককে ধরার জন্য ছুটি। চালককে না ধরতে পারলে গাড়িটি জ্বালিয়ে দিই।

‘এটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। উত্তেজিত জনতা সেটাই করে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও অনেকবার বলেছেন, চালক সবসময় দায়ী নন।’

হাইওয়েতে ভারী যানবাহনের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে কাজ চলছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মহাসড়কগুলোতে ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন করা হচ্ছে। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেক কমবে।

‘পাশাপাশি হাইওয়ে বা মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা পৃথক একটা পুলিশ বাহিনী তৈরি করেছি। মহাসড়কগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ক্যামেরার আওতায় এসেছে।’

সড়ক দুর্ঘটনা যেকোনো মহামারির চেয়েও ভয়াবহ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে যত প্রাণঘাতী রোগ রয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর কারণ গবেষণা করে অধ্যাপক সামছুল হক তুলে ধরেছেন।’

সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ছবি: সংগৃহীত

অনুষ্ঠানে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান বলেন, ‘ড. সামছুল হকের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ডক্যুফিল্ম আমরা সারা দেশে দেখাব। বিচারকদের কাছে এটা পাঠাব, দেখুন কী অন্যায় আপনারা করেছেন। কোন আইনে একজন বাসচালককে এভাবে স্যোশাল ক্রসফায়ারে হত্যা করলেন!’

তিনি বলেন, ‘এই ফিল্মের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে ওই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যে ব্যক্তিকে সোশ্যাল ক্রসফায়ারে হত্যা করা হলো, সেই চালক জামির হোসেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন না।’

তিনি বলেন, ‘সব দুর্ঘটনার তদন্ত শুধু পুলিশ দিয়ে করলে হবে না। এ বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের দিয়ে তদন্ত করলে প্রকৃত দোষী বেরিয়ে আসবে। সঠিক তদন্তে কোনো চালক দোষী হলে তার সাজা আমরা মাথা পেতে মেনে নেব, তবে অন্যায়ভাবে শুধু চালককে দায়ী করে ফাঁসি চাইলে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।’

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হকও বক্তব্য দেন।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে যে ফ্যাক্টগুলো পেয়েছি, তা কখনও পুলিশের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, কখনও বিআরটিএর বিরুদ্ধে বা কখনও প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধেও যাচ্ছে।

‘আমি বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে দেখেছি, সত্যটা বের করার চেষ্টা করেছি। নিরাপরাধ কোনো ব্যক্তির যাতে সাজা না হয় সেটার জন্য আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে সব কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করে আমি এটা করেছি।’

অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘একটি ঘটনার বহুমাত্রিক কারণ থাকতে পারে, দায় আলাদা আলাদা হতে পারে। দায় কারও কম, কারও বেশি এমনটা হতে পারে। আমরা দেখছি দুর্ঘটনার পরে তদন্তের জন্য যে কমিটি হয় সেখানকার সদস্যরা বিজ্ঞানের না। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা তারা দিতে পারবেন না। এ ধরনের কমিটির তদন্ত থেকে ভালো কিছু বের হয়ে আসবে না।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সফল রাষ্ট্রগুলো শুধু চালককে নিয়ে চিন্তা করেনি। তারা পুরো সিস্টেম নিয়ে চিন্তা করেছে। একটি দুর্ঘটনার সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। সবগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাহলেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।’

বক্তব্যে বাসচালক জামির হোসেনকে নিয়ে নিউজবাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভূয়সী প্রশংসা করেন সামছুল হক। তিনি বলেন, এসব প্রতিবেদনের কারণেই তার গবেষণার বিষয়টি সবার সামনে এসেছে।

ডক্যুফিল্ম ‘স্যোশাল ক্রসফায়ার’ এর একটি দৃশ্য

তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরদের মাইক্রোবাসের সঙ্গে জামির হোসেনের বাসের সংঘর্ষ নিয়ে ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানভিত্তিক একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউজবাংলা।

দুর্ঘটনার জন্য জামির হোসেনকে দায়ী করে বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন সাজা দেয়ার পাশাপাশি আরেকটি মামলায় তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাসমালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে বিবাদীদের আপিল শুনানির অপেক্ষায়।

এ ছাড়া মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণের আরেকটি মামলা হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ওই দুর্ঘটনার ১১ বছর পরও তিনটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি আদালতে। বাসচালক জামিরও মারা গেছেন দুই বছর আগে। তার সাজার বিরুদ্ধে আপিল এবং ক্ষতিপূরণের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হতে পারে, সে বিষয়ে বাদী-বিবাদী কোনো পক্ষেরই ধারণা নেই।

সারা দেশকে নাড়া দেয়া ২০১১ সালের ওই সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ছাড়াও তাদের মাইক্রোবাসচালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন মারা যান। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল-মামুনসহ আহত হন পাঁচজন।

তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর ও চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসের চালক জামির হোসেন

কী আছে ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানে

মর্মান্তিক ওই সড়ক দুর্ঘটনাটি নিয়ে নিউজবাংলার কাছে গত বছর নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন অধ্যাপক সামছুল হক। সে সময় তিনি বলেন, ‘তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যু অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা। ওই দুর্ঘটনার পর পরই আমি এর কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করি। অনুসন্ধানের একদম শুরুতে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন।

‘তারা প্রথম দিনে ঘটনাস্থলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। কিছু ছবি তোলা হয়েছিল উঁচু গাছ থেকে, যেগুলো আমার কাছে ছিল সারকামসটেন্সিয়াল এভিডেন্সের মতো। সেসব ছবি দেখে আমি বুঝেছিলাম, এখানে অনেক কিছু বলার মতো বিষয় লুকিয়ে আছে।’

তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছ থেকে আরও বেশ কিছু কনটেন্ট পেয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ভিডিও ছিল, যেখানে বাসের উইন্ডশিল্ডের কাছে বসা একজন নারীর কথা ছিল। তার সাবলীল বিবরণ থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক নতুন কিছু পাওয়ার আছে।’

ড. সামছুল হক নিজেও পরদিন দুর্ঘটনাস্থলে যান। বিভিন্ন আলামত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি কথা বলেন স্থানীয় লোকজন ও তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘একে একে বিভিন্ন বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাধারণ বিবরণের মধ্যে গোঁজামিলগুলোও ধরা পড়ছিল। তখনও আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি ভালোভাবে দেখতে পারিনি। ওটা একদম চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। মাইক্রোবাসে কে কার পাশে বসেছিলেন, সেটা তখনও আমি জানতাম না।’

তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধানের পাশাপাশি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষা করছিলাম। তিন সদস্যের এ কমিটির সঙ্গে আমার একজন সাবেক ছাত্রও যুক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। একই সঙ্গে আমার কাছে যেসব তথ্য-প্রমাণ ছিল, সেগুলো একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছিলাম। তবে এর মধ্যে খণ্ড খণ্ড বেশ কিছু মিসিং লিংক ছিল।

‘এর মধ্যেই ডেইলি স্টারে তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। মনীশ ছিলেন মাইক্রোবাসচালকের ঠিক পাশের আসনে; দুর্ঘটনায় তিনিও সামান্য আহত হন। মনীশের বক্তব্য থেকে এমন কিছু বিষয় পাই, যেটি আমার প্রাথমিক অনুসন্ধানকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।’

ড. সামছুল হক বলেন, ‘সাধারণভাবে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষার কথা। হার্ড ব্রেক অ্যাপ্লাই করলে রাস্তায় একটি স্কিড মার্ক পাওয়া যায়। আর সেই স্কিড মার্ক পেলে গাড়ির আসল অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। অথচ আমি রাস্তায় কোনো স্কিড মার্ক পাইনি।

‘আমরা যারা দুর্ঘটনা বিষয়ে কাজ করি, তাদের কাছে বিষয়টি গোলমেলে। আমি তখন ভাবার চেষ্টা করছিলাম, বৃষ্টির কারণেই রাস্তায় হয়তো স্কিড মার্ক নেই। তবে সেটা মিলছিল না। স্কিড মার্ক এমন একটি বিষয় যার কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবেই। কারণ এ সময় চাকার প্রচণ্ড ঘর্ষণে রাস্তার পাথরকুচি উঠে যায়।’

মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরদের দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাস

তিনি বলেন, ‘তাহলে কেন এ ধরনের চিহ্ন নেই- সেটি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। অবশেষে সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল মনীশ রফিকের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মাইক্রোবাসের পেছন দিকে যাত্রীরা মুখোমুখি বসে তুমুল আড্ডায় মেতেছিলেন। তার কথার প্রতিটি বিষয় আমার সামনে একেকটি চিত্র তৈরি করছিল। মাইক্রোবাসে মুখোমুখি কী করে বসা যায়! তার মানে সেটির আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। মনীশ আরও বলেন, হঠাৎ একটি বাস দৈত্যের মতো তাদের মাইক্রোবাসে আঘাত করে।’

এই ‘হঠাৎ’ শব্দটি অনেক প্রশ্নের জবাব পাইয়ে দেয় ড. সামছুল হককে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ হলেই তো গাড়ির স্কিড মার্ক পাওয়া যায় না! কিছু দূর আগে থেকে দেখতে পেলেও হার্ড ব্রেক কষা সম্ভব, কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছিল যে কারণে বাসটিকে তারা হঠাৎ দেখতে পেলেন!’

এরপর আবার দুর্ঘটনাস্থলে যান ড. সামছুল হক। এ সময় স্থানীয় একজনের বক্তব্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য ছাপা হয়।

এসব থেকে পরিষ্কার হয়, দুর্ঘটনার ঠিক কিছু আগে একটি বড় বাস রাস্তার বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিকশাকে ওভারটেক করে। ওই বাসটির পিছু পিছু একই দিকে যাচ্ছিল তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাস। ওই বাসটির পিছু নিয়ে তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটি অটোরিকশাকে একইভাবে ওভারটেক করতে বাঁকের মুখে নিজের ডান লেনে চলে গিয়েছিল। এ সময়েই বাঁকের বিপরীত দিক থেকে আসা জামির হোসেনের বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসটির সংঘর্ষ হয়।

ড. সামছুল হকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান

ড. সামছুল হক বলেন, ‘অটোরিকশাকে ওভারটেক করা বাসটির চালক কিন্তু বাঁকের অন্য প্রান্তে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটিকে দেখতে পেয়েছিলেন। এর পরও তিনি ক্যালকুলেটেড (হিসাব করা) ঝুঁকি নিয়ে অটোরিকশাকে ওভারটেক করে আবার নির্ধারিত বাম লেনে বাসটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-ট্রাক সাধারণত এ ধরনের হিসাবি ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত।

‘তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটিও সামনের বাসটিকে অনুসরণ করে ডান লেনে চলে যায়। তবে একজন শহুরে চালকের জন্য কাজটি ছিল মারাত্মক ভুল। সামনের বাসের মতো তিনি আর মাইক্রোবাসকে আবার বাম লেনে নিতে পারেননি। আর এই ভুলের কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়।’

বিপরীত দিকের বাসের চালক জামির বাঁকের মুখে নিজের সঠিক বাম লেনেই ছিলেন বলে মনে করছেন ড. সামছুল হক।

তিনি বলেন, ‘উল্টো দিকে আকস্মিকভাবে ভুল লেনে চলে আসা মাইক্রোবাসের বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসচালক জামির হোসেনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কারণ বাঁকের উল্টো দিক থেকে তিনি মাইক্রোবাসটিকে দেখতেই পাননি। আর এ জন্যই সেই হঠাৎ দুর্ঘটনা, যেখানে বাসচালক ব্রেক কষারও সময় পাননি।’

মাইক্রোবাসের সঙ্গে যেভাবে বাসের সংঘর্ষ

দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তায় এর বাম দিকের লেনে পাওয়া যায়। ফলে মামলার রায়ে বিচারিক আদালতের বিচারক বিষয়টির উল্লেখ করে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে মাইক্রোবাসটি তার সঠিক লেনেই ছিল।’

তবে ড. সামছুল হক বলেন, এখানে বোঝার ভুল আছে। বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ড. সামছুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, “সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটির টার্মিনাল পজিশনের বেশ কিছু ছবি পেয়েছিলাম। একটি দুর্ঘটনাকে বিশ্লেষণের জন্য ‘টার্মিনাল পজিশন’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা হলো দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির চূড়ান্ত অবস্থান।”

মাইক্রোবাসে যাত্রীদের অবস্থান এবং যেভাবে আঘাত

তিনি বলেন, “এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কোনো মাইক্রোবাস যদি তার ‘সঠিক’ লেনে থাকে (যদিও সে অবস্থানটিও ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর), তাহলে ধরে নিতে হবে দুর্ঘটনার আগের চিত্র ছিল অন্যরকম। কারণ একটি বাসের যে ভর ও গতি, তাতে সংঘর্ষের পর মূল অবস্থান থেকে মাইক্রোবাসটির বেশ কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার কথা। মাইক্রোবাসের জীবিত আরোহীদের বক্তব্যেও সেটি জানা গেছে। ফলে দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে রাস্তার মাঝ বরাবর পাওয়ার অর্থ হলো, প্রকৃতপক্ষে সেটি রং সাইডে ছিল। ধাক্কা খাওয়ার পর এর টার্মিনাল পজিশনটি পাওয়া গিয়েছিল মধ্যরাস্তায়।

“আর দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসটি সত্যিই নিজের বাম লেনে থাকলে ধাক্কা খাওয়ার পর সেটির রাস্তার কিনারায় বা রাস্তার পাশে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এটাই হলো বিজ্ঞান। অথচ বিচারপ্রক্রিয়ায় এই বিজ্ঞানকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।”

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসের অবস্থা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে, বাসের সঙ্গে এর আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ডিভাইডারবিহীন একটি সড়কে এ ধরনের আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হলে দুটি যানের যেকোনো একটিকে রং সাইডে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান এবং সংঘর্ষে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, মাইক্রোবাসটিই ওভারটেক করতে গিয়ে রং সাইডে ছিল। দুর্ঘটনার পর সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ও মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তবে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।’

দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাস ও বাসটির অবস্থান

দুর্ঘটনার জন্য সে সময় রাস্তার ‘অবৈজ্ঞানিক’ বাঁককেও দায়ী করছেন ড. সামছুল হক।

তিনি বলেন, ‘১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। তবে বাস্তবে তা ছিল না। একই সঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম।

‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাকস্পট ছিল, এই বাঁকটি তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতি বছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর দুর্ঘটনা হচ্ছে না।’

পুলিশ হেফাজতে বাসচালক জামির হোসেন

সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন আয়োজিত ডক্যুফিল্ম প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার, বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজও বক্তব্য দেন।

এ বিভাগের আরো খবর