ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ঝোড়ো বাতাসে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে পার্ক কিংবা উদ্যানে লাগানো গাছের চেয়ে বেশি উপড়ে গেছে সড়কের আইল্যান্ড এবং ফুটপাত ঘেঁষে লাগানো গাছগুলো।
উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, তাদের এলাকায় গতরাতের ঝড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুইশতাধিক গাছ ভেঙে পড়ছে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সুনির্দিষ্ট করে সংখ্যা না বলতে পারলেও আনুমানিক দেড় থেকে দুইশ গাছ ভেঙে পড়েছে বলে ধারণা করছে।
প্রবল ঝড়ের পাশাপাশি অল্প ঝড়েও রাজধানীর রাস্তায় গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কখনও কখনও ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও। প্রশ্ন উঠেছে, খোলা মাঠের চেয়ে সড়কের আশপাশে লাগানো গাছই কেন বেশি পড়ছে?
উদ্ভিদ বিশেজ্ঞরা বলছেন, এত বড় ঝড়ে কিছু গাছ পড়বে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সোমবার রাতে এত গাছ পড়া অস্বাভাবিকভাবে নেয়া যায় না। এ ছাড়া সাধারণ ঝড়েও রাজধানীর সড়কে ওপর হারহামেশা গাছ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মূলত রাস্তার মাঝে বা ফুটপাতে লাগানো গাছ শক্ত কোনো ভিতের ওপর না থাকা এবং নার্সারি থেকে প্রধান মূল কাটা গাছ সংগ্রহ করে রোপণ করার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমান বাস্তবতাকে সামনে রেখে আগামীতে সড়ক ও ফুটপাত তৈরির সময় সেখানে লাগানো গাছ যাতে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সেটা মাথায় রেখেই কাজ করা হবে।
গতরাতে সিত্রাং নামক ঘূর্ণিঝড়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের ওপর গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায়। রাতেই সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকটি টিমকে সেই সব গাছ অপসারণের কাজ করতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কাজ করে সব গাছ অপসারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
উত্তর সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, গত রাতের ঝড়ে উত্তর সিটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই শাতাধিক গাছ ভেঙে পড়েছে। রাত থেকে আজ (মঙ্গলবার) দুপুর পর্যন্ত আমাদের ১০টি অঞ্চলের ১০টি টিম কাজ করে পড়ে যাওয়া গাছগুলো অপসারণ করেছে। এখন মোটামুটি সব সড়কই চলাচলে উপযোগী হয়েছে।’
আর দক্ষিণ সিটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না বলতে পারলেও দেড় থেকে দুই শতাধিক গাছ পড়েছে বলে জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপড়ে পড়েছে ২০টি গাছ। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবনের সামনে থাকা আরও কিছু গাছ পড়েছে।
গত রাতের ঝড়ে মোহাম্মাদপুরের আসাদ গেট এলাকায় ফুটপাতের ওপর থাকা একটি বড় গাছ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সকালের মধ্যেই সড়কের ওপর থেকে সেটি অপসারণ করে সিটি করপোরেশন। দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতের ওপর গাছের গোড়ালি পড়ে আছে। তবে পুরো গাছের ডাল-পালা কেটে নিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় পথচারী হাবিব রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাশের গলিতেই আমি থাকি। মধ্যরাতে জোরে একটা শব্দ শুনতে পাই। তখন ভেবেছি বাস এক্সিডেন্ট করেছে। বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা নিয়ে এখান এসে দেখি বাতাশে এই গাছ পড়ে গেছে। ভাগ্য ভালো, তখন এখানে কোনো মানুষ ছিল না, থাকলে বড় কিছু হয়ে যেত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এইখানে একটু জোরে ঝড় হলেই গাছ পড়ে যায়। মূলত এইখানের মাটি ভালো না। তাছাড়া গাছের এক পাশেই রয়েছে ইটের প্রাচীর আর এক পাশে রয়েছে রাস্তা। এর মাঝে তো গাছের শিকড় বেশি দূরে যেতে পারে না। যার কারণে এখানে একটু জোরে বাতাস হলেই মাঝে মাঝে গাছ পড়ে যায়।’
রাস্তার মাঝে ও পাশের লাগানো গাছ কেন বেশি উপড়ে যায় এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আশফাক আহম্মেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গাছ পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই আমাদের শহরের বেশিরভাগ রাস্তার মাঝের আইল্যান্ড প্রশস্ত নয় এবং এর গভীরতাও বেশি নয়। দেখা যায়, আইল্যান্ড তৈরির সময় নিচের কনক্রিট বা ইট জাতীয় বস্তু রেখেই তা তৈরি হয়। এ কারণে গাছের শেকড় বেশি বিস্তৃতি লাভ করতে পারে না।
‘এ ছাড়া ফুটপাত ও আইল্যান্ড ভালো মাটি দিয়েও ভারাট করে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার কারণে আমরা দেখতে পাই একটু ঝোড়ো হাওয়া হলেই শহরের কোথাও না কোথাও রাস্তায় গাছ পড়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সড়কের পাশে পর্যাপ্ত জায়গাও নেই। তারপরও কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এই বিষয়গুলো নজরে রেখে পরিকল্পনা করে গাছ লাগানো।’
বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের উপবন সংরক্ষক (বন ভবনের রিমস্ ইউনিট) মোহাম্মাদ জহির ইকবাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন মূলত ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতার গাছ রোপণ করে, যাতে গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলতে না পারে। এই গাছগুলো যেহেতু ২ থেকে ৩ বছর নার্সারিতে থাকতে হয়, তাই এই গাছগুলোর মূল মাটির গভীরে চলে যায়। যখন নার্সারির মালিক এই গাছগুলো টবে বা পলিব্যাগে উঠিয়ে বিক্রি করেন, তখন মাটির গভীরে থাকা গাছের প্রধান শেকড় কেটে ছোট করে তুলে আনেন। এতে হয়তো গাছ বাঁচে, কিন্তু প্রধান শেকড় না থাকায় এই গাছগুলোর মূল এবং শিকড় বেশি দূর যেতে পারে না। স্বভাবিকভাবেই এই গাছ একটু জোরে ঝোড়ো হাওয়া হলেই উপড়ে পড়বে। রাস্তার পাশের গাছ উপড়ে পড়ার এটা একটা বড় কারণ।
‘আর একটা কারণ হলো রাস্তার আইল্যান্ড বা ফুটপাতে চারপাশে কনক্রিট থাকে, যার কারণে গাছের শিকড় গভীরে যেতে পারে না। এ ছাড়া শহরে লাগানোই ঠিক না এমন গাছও আমরা এই শহরে লাগাচ্ছি। যে গাছগুলো একটু বড় হলেই ফাঁকা জায়গায় থাকলেও জোরে বাতাসে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ সেলিম রেজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তার পাশে লাগানো এই গাছগুলো যে শক্ত ভিতের ওপর থাকা দরকার, সেই ভিতের ওপর থাকে না। ছোট একটা আইল্যান্ডের ওপর যখন একটা মাঝারি বা বড় গাছ থাকে, তখন বাতাসে সেটা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর শিকড়ই তো বেশি দূর যেতে পারে না। এ কারণে দেখা যায়, ঝড় হলে রমনা পার্কসহ অন্যান্য পার্কের গাছের খুব একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু একই ঝড়ে রাস্তার আইল্যান্ড বা ফুটপাত ঘেঁষে লাগানো গাছ উপড়ে যায়।
‘আমরা চেষ্টা করছি ভবিষ্যতে আমাদের যে রাস্তাঘাট তৈরির সময় সেগুলো এমনভাবে তৈরি করব, যাতে আমাদের রাস্তার পাশের এই গাছগুলো শক্ত ভিত পায়। আমরা সেই পরিকল্পনা তৈরির চেষ্টা করছি। তবে এটা স্বাভাবিক যে সিত্রাংয়ের মতো একটি ঝড়ে শহরের কিছু গাছ পড়বেই। পৃথিবীর সব দেশেই এমন ছবি আমরা দেখতে পাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই রকম ঝড়ে সব জায়গায় গাছ উপড়ে যায়, তবে সেগুলো আমাদের জনজীবনে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না বলে সেটা আমাদের দৃষ্টিতে তেমন একটা আসে না। রাস্তা ওপর সবার দৃষ্টি থাকে বলেই সবাই এটা দেখতে পায় এবং এটা নিয়ে আলোচলা করে।’
গাছের প্রধান মূল কেটে ফেলা গাছ কিনে সিটি করপোরেশন লাগাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম রেজা বলেন, ‘এ বিষয় আমার জানা নেই। এ রকম ঘটনা ঘটলে আগামীতে গাছ দেখেশুনে লাগাব।’