ডেটা এন্ট্রি অপারেটর আর নিরাপত্তাপ্রহরী দিয়ে চলছে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের কিশোরগঞ্জ জেলা কার্যালয়। মূল ফটক সারা বছর থাকে তালাবদ্ধ। কর্মকর্তারাও মন চাইলে আসেন মাঝেমধ্যে। পরিত্যক্ত পড়ে আছে অফিসকক্ষগুলো। ভেতরে কয়েকটি চেয়ার-টেবিল আর একটি স্টিলের আলমারি ছাড়া আর কিছুই নেই।
কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া কোয়ার্টারগুলোতে থাকে এক মৎস্যজীবী লীগ নেতার গরু আর হাঁস-মুরগি। প্রথমে দেখলে মনে হবে এটি যেন গোয়ালঘর। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর সেখানে বখাটেদের আড্ডা আর জুয়া-মাদকের আসর বসে বলে অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের।
কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সর্বশেষ কবে এসেছিলেন সেটাও সঠিক করে বলতে পারেন না কেউ। উপপরিচালকের কক্ষের বাইরে নেই নামফলক, পুরো অফিসের ভেতরে কোথাও নেই জাতির পিতা এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি।
সরেজমিনে শহরের পূর্ব তারাপাশা এলাকায় অধিদপ্তরটির জেলা কার্যালয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র!
অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সেখানে হাঁস-মুরগি আর গরু পালন এবং মাদকসেবীদের আনাগোনার বিষয়টি তারা অবগত নন। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অনুন্নত যোগাযোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হাওরের জেলাগুলো উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সেখানকার জনমানুষের দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের নির্দেশ দেন। পরে ১৯৭৭ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হলেও ১৯৮২ সালে এই বোর্ডের বিলুপ্তি ঘটে।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তের আলোকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমির উন্নয়নে দিকনির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন জাতীয় কমিটি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই কমিটির চেয়ারপারসন।
কর্মীশূন্য অফিসকক্ষ। ছবি: নিউজবাংলা
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার নিম্নভূমি নিয়ে হাওর অঞ্চল। এই অঞ্চলের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য ২০১২ সালে ২০ বছর মেয়াদি হাওর মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যাতে ১৭টি উন্নয়ন ক্ষেত্রে ১৫৪টি উন্নয়ন প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের ৪০টি সংস্থা এ পর্যন্ত ১১০টির বেশি প্রকল্প নিয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই অধিদপ্তরের মাধ্যমে হাওর ও জলাভূমি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বন্যা ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতার মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির কথা থাকলেও এই কার্যালয়ের বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
জেলা কার্যালয়ের মূল ফটক সারা বছরই থাকে তালাবদ্ধ। দুটি আধা পাকা ঘরের একটিতে অফিস আর অপরটিতে আবাসিক কোয়ার্টার। অফিস ভবনে আটটি কক্ষ রয়েছে। এর একটিতে বসেন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। বাকিগুলোতে কয়েকটি চেয়ার-টেবিল আর একটি স্টিলের আলমারি ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি।
অন্য ভবনে কক্ষ রয়েছে ছয়টি। এর একটিতে থাকেন নিরাপত্তাপ্রহরী। বাকিগুলোতে পালন হচ্ছে হাঁস-মুরগি আর গরু।
বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতে সরেজমিনে দেখা যায়, কোয়ার্টারের বারান্দায় রাখা বেশ কয়েকটি রাজহাঁস আর ৬ নম্বর কক্ষে রাখা আছে গরু। ৪ ও ৫ নম্বর কক্ষে রাখা আছে গরুর জন্য খড় ও কাঁচা ঘাস। সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে কয়েকজনকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। তালাবদ্ধ কার্যালয়ে তারা কীভাবে প্রবেশ করল, এমন প্রশ্নে নীরব ভূমিকা পালন করেন নিরাপত্তাপ্রহরী।
কিশোরগঞ্জ কার্যালয়ের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর ইকবাল হোসেন জানান, তিনি এখানে যোগদান করেছেন ২০১৫ সালে। এরপর থেকেই এখানে তিনি আর নিরাপত্তাপ্রহরী ছাড়া আর কেউ থাকেন না। এই কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে পরিদর্শনে এসে আবার চলে যান।
ইকবাল হোসেন জানান, এই কার্যালয়ে ১৫ জন লোকবল থাকার কথা থাকলেও আর কেউ নিয়োগ হননি। এখানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সর্বশেষ কবে এসেছিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সঠিক করে বলতে পারব না। তবে আনুমানিক ছয়-সাত মাস আগে মহাপরিচালক এই কার্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন। তখন উপপরিচালক স্যারও সাথে এসেছিলেন। এ সময় তারা কয়েকটি বৃক্ষ রোপণ করে চলে যান। পরে আর কেউ আসেননি।’
কার্যালয়ের মূল ফটক সব সময় তালাবদ্ধ থাকে কেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখানে তো আমরা দুইজন ছাড়া অফিস স্টাফও কেউ নেই। তা ছাড়া সচরাচর কারও কাজও পড়ে না। সকল কাজ ঢাকা অফিস থেকেই পরিচালিত হয়। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে তালাবদ্ধ রাখি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে বহিরাগতরা এসে আড্ডা দিতে চায়। নিষেধ করতে গিয়ে আমি বেশ কয়েকবার মারধরের শিকার হয়েছি।’
কোনো কার্যক্রম ও লোকবল না থাকায় অফিস সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। ছবি: নিউজবাংলা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ‘এই কার্যালয়ে কোনো প্রকার কার্যক্রম ও লোকবল না থাকায় অফিস সব সময়ই তালাবদ্ধ থাকে। তবে সন্ধ্যার পরে প্রায়ই এখানে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসে অনৈতিক আড্ডায় মেতে ওঠেন। অনেক সময় স্থানীয় উঠতি বয়সী যুবকেরা এসে নেশা ও জুয়ার আড্ডাও বসান।’
এ বিষয়ে নিরাপত্তাপ্রহরী আব্বাস আলী চৌকিদার জানান, এ অফিসে তিনি আর ডেটা এন্ট্রি অপারেটর ইকবাল হোসেন ছাড়া আর কেউ আসেনও না, থাকেনও না। ২০২০ সালে তিনি এখানে যোগদান করেছেন। তখন থেকেই কক্ষগুলো খালি পড়ে থাকে। সে কারণে সেখানে গরু আর হাঁস-মুরগি পালন করেন তিনি।
একপর্যায়ে তিনি জানান, এই গরু তার নিজের না। জেলা মৎসজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেন তাকে লালনপালনের দায়িত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়া কার্যালয়ের ভেতরে অনৈতিক আড্ডা, জুয়া খেলা ও মাদক সেবনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
এ বিষয় জেলা মৎসজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নিরাপত্তাপ্রহরী আব্বাস আলী তার কাছ থেকে গরু বর্গা নিয়ে লালনপালন করছেন। আব্বাসের অনুরোধেই তাকে গরু কিনে দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. খাইরুল আলম সুমন কিশোরগঞ্জ কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে তার মুঠোফোন ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় জেনেই তিনি ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি৷
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. আলী মুহম্মদ ওমর ফারুক মুঠোফোনে জানান, এই কার্যালয়ে একজন উপপরিচালকসহ ১৫ জনের লোকবল থাকার কথা। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় সেখানে একজন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর আর একজন নিরাপত্তাপ্রহরী ছাড়া আর কেউ থাকেন না। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে অচিরেই সেখানে কার্যক্রম শুরু হবে। তবে সেখানে হাঁস-মুরগি আর গরু পালন এবং অনৈতিক আড্ডা বসার বিষয়টি তারা অবগত নন। এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলেও জানান তিনি।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমকে বিষয়টি অবগত করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’