নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলনের ফলে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও বিধিমালা তৈরি হয়নি। সড়ক পরিবহন আইনের মতো অনেক আইনেরই বিধিমালা নেই।
এ বিষয়ে আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতটা গুরুত্ব দিয়ে আইন তৈরি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য ততটা গুরুত্ব দিয়ে বিধিমালা তৈরি না করায় সড়ক আইন অকার্যকর হয়ে আছে। আর এ আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা কমার কোনো লক্ষণ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত দ্রুত জনগণের মতামত নিয়ে জনবান্ধন একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা।
দীর্ঘ দিনেও বিধিমালা না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন আইন করা হয়, তখন অনেক আইনেই বিধিমালার কথা বলা থাকে। আইনের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় থাকে, যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে গেলে বিধিমালার দরকার পড়ে। এই বিধিমালা সরকারের পক্ষ থেকেই করা যায়। সড়ক আইনে অবশ্যই বিধিমালা প্রয়োজন।’
আইন করার পর দীর্ঘ চার বছরে আইন কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এত দিনেও আইনটি বাস্তবায়ন কেন করা হচ্ছে না তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। আইন বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আইন করার পরও কোন অদৃশ্য শক্তির কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না, সেটা একটা প্রশ্ন।’
আইন পাসের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে হাইকোর্টের রিট দায়েরের পর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। গেজেটের পর গত দুই বছরেও আইন বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী সুপ্রিমকোর্টের আরেক আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন একটা আইন হয়, তখন ওই আইন কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেটা স্পষ্ট করার জন্য বিধিমালা প্রয়োজন। অনেক আইন আছে যেখানে বিধিমালার কথা উল্লেখ থাকে। আবার অনেক আইনে বিধিমালার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ইদানিং দেখছি আইন উল্টে দিয়ে বিধিমালা হচ্ছে। যেমন শ্রম আইনে উল্টো বিধিমালা করা হয়েছে, সেটাও ঠিক না।’
তিনি বলেন, ‘আইন যেটা বলেছে, বিধিমালায় কিন্তু তার মতো করেই তা বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সেটা বলা থাকবে। কিন্তু আইনের উল্টো বিধিমালা করলে তো ঝামেলা। তাহলে তো এটা বাস্তবায়ন করা যাবে না। সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।’
সড়ক আইন বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ আইনজীবী বলেন, ‘আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বিধিমালা করা প্রয়োজন।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইন প্রণয়নের পর দীর্ঘ চার বছর পর আজকে আমরা জানতে পারলাম বিধিমামলা চুড়ান্ত করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, যে আইনটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেটির বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে সাধারণ মানুষের মতামত না নিয়ে।’
তিনি বলেন, ‘যে আইন ও বিধিমালা দেশের প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটি জনগণের মতামত নিয়ে করা দরকার ছিল। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক আইন বাস্তবায়নে কোথায় সমস্যা, সেটি কিন্তু গবেষণার দাবি রাখে।’
তিনি বলেন, ‘সড়ক আইন নিয়ে শত শত সুপারিশ থাকলেও সরকার কোনো সাড়া দিচ্ছে না।’
যাত্রীদের পক্ষে কাজ করা এ নেতা বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শুধু মালিক-শ্রমিক নিয়ে বৈঠক করেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। এর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আইন বাস্তবায়ন।’
লাইসেন্স ও ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ-এর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে ঘণ্টায় ৫শ জনের পরীক্ষা নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয় না। তাছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস দেয়ার ঘটনাও আছে আমাদের দেশে। যতদিন এ ধরনের অনিয়ম দূর করা সম্ভব হবে না, তত দিন নিরাপদ সড়কের সুফল পাওয়া যাবে না।’
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের বিষয়টি উল্লেখ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির এ নেতা বলেন, ‘গত ৭ বছরে সড়কে ৩৭ হাজার দুর্ঘটনায় ৫১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর থেকে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে।’
এ দিকে সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বিধিমালাটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহে সেটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে যাবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী।