দুই যুগ পর ভোটের মাধ্যমে বগুড়া বিএনপির কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। এর কারণ, ভোটার তালিকায় ‘কারসাজি’।
নেতারা অভিযোগ করছেন, তালিকা কাটছাঁট করা হয়েছে। অনেক ত্যাগী নেতাকে ভোটার করা হয়নি। বাদ পড়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদকও। এ নিয়ে দলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। নেতারা একে প্রহসনের নির্বাচনও বলছেন।
জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, দলের ভেতর গ্রুপিং ও ভোটের মাঠে কর্তৃত্ব রাখতে ইচ্ছা করেই এমন কৌশল নেয়া হয়েছে। তারা বলছেন, এভাবে ভোট হলে তাতে গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকবে। অথচ এই ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় বগুড়াই ছিল বিএনপির জন্য মডেল।
১৯৯৯ সালে বগুড়া বিএনপিতে প্রথম গোপন ব্যালটে নেতা নির্বাচন করা হয়। এরপর দেশের অন্য জেলাগুলোতেও একইভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন শুরু হয়।
কিন্তু ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল বগুড়ায় কোনো সম্মেলন ছাড়াই জেলা বিএনপির কমিটি গঠন হয়। ২০১৯ সালের থেকে কয়েকটি আহ্বায়ক কমিটি থাকার পর সম্প্রতি আবার ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আগামী ২ নভেম্বর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক এই তিন পদে নেতা নির্বাচন করবে দলটি। সভাপতি পদে সাবেক রেজাউল করিম বাদশা এবং সাইফুল ইসলামের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে নেতাকর্মীদের ধারণা।
এই নির্বাচন করতে গত ১৯ অক্টোবর ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তালিকায় একাধিক নেতাদের নাম না থাকায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সঠিক সংখ্যা না জানালেও প্রায় ৩০ জনের নাম বাদ পড়ার কথা জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতারা জানান, যারা থানা ও পৌর বিএনপিতে ভোট করে হেরেছেন তাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তবে এটা শুধুমাত্র একটা ইস্যু। দলের ভেতর কোন্দল আছে। এ কারণে ইচ্ছা করেই অনেককে বাদ রেখে তালিকা করা হয়েছে।
এই কোন্দলের জন্য তারা সভাপতি প্রার্থী রেজাউল করিম বাদশার দিকে আঙ্গুল তুলছেন।
তবে জেলা বিএনপির নির্বাচন কমিটি এটিকে নিছক একটি ভুল হিসেবে দেখছে। কিন্তু এমন ভুলের সমাধান সম্পর্কে কোনো কিছু পরিষ্কার করতে পারেননি তারা।
গত ১৯ অক্টোবর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন মনোয়ন জমা দিতে যান। ২০১০ সালে তিনি সাধারণ সম্পাদক হন। ওই কমিটিতে সভাপতি ছিলেন সাইফুল ইসলাম।
এবার জয়নাল আবেদীন আবার সাধারণ সম্পাদক পদে মনোয়ন নিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটার তালিকায় নিজের নাম না পেয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। একই দিন আরও কয়েকজন তালিকায় নাম নতুন করে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য লিখিত আবেদন দেন।
এ বিষয়ে জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার দুদিন পর ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। আমি বিষয়টি খেয়াল করিনি। নির্বাচনের নমিনেশন নেয়ার পর প্রতীক নিতে গেলে ভোটার তালিকায় আমার নাম না থাকার বিষয়টি জানতে পারি। তখন বিষয় জানালে সবাই বলেন যে ভুলে এটি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিন জেলা বিএনপির সাবেক সম্পাদক ও আহ্বায়ক কমিটিরও সদস্য ছিলাম। বর্তমানে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। আমার নাম যদি না থাকে, তাহলে কী হয়েছে বুঝে নেন।
‘এখন সুযোগ থাকলেও আমি তো আর ভোট করব না। দলকে ভালোবেসে অনেক দিয়েছি। ভবিষ্যতেও দিয়ে যাব। ভোটের দরকার নেই।’
ভোটার তালিকায় বাদ পড়ার নেতাদের মধ্যে আছেন সাইদুজ্জামান শাকিল। তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত করার জন্য লিখিত আবেদনও করেছিলেন তিনি। তবে বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি।
কেন তাকে বাদ দেয়া হলো এমন প্রশ্নে শাকিল বলেন, ‘দলে পক্ষ-বিপক্ষ থাকেই। সেখান থেকে এ কাজ হয়েছে। নির্বাচনে মনোয়ন নেয়ার আগে জেলা আহ্বায়ক ছিলেন রেজাউল করিম বাদশা। সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন। এখন তালিকা প্রকাশের পর কমিটি বলছে ভুলে এটা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো পুরোনো নেতা-কর্মীদের বাদ দেয়াকে ভুল বলেই তো আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’
সাইদুজ্জামানের ভাষ্য, ‘আমাদের এ সমস্যার সমাধান না হলে ভোটের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এখানে অস্বচ্ছতার রেশ থেকেই যাচ্ছে। একটা পক্ষ চাচ্ছে সব তাদের মতো করতে। তারা তফসিল ঘোষণার আগেই গোপনে এসব করেছেন। কিন্তু লিডার (তারেক রহমান) সব কিছু দেখছেন। তিনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন।’
বাদ পড়া আরেক নেতা বগুড়ার তালোড়ার যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন স্বপন। তার এলাকার অন্তত ৮ জনের নাম ভোটার তালিকায় বাদ দেয়া হয়েছে। তালিকায় নাম না দেখে স্বপন চিঠি দেন জেলা কমিটিকে। কিন্তু তারা চিঠি নিয়ে রেখে দিয়েছেন। আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
স্বপন বলেন, ‘আমরা জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি সিপার আল বখতিয়ারের সঙ্গে রাজনীতি করেছি। এ জন্য আমাদের বিপক্ষরা জানেন আমরা তাদের ভোট দেবো না। এ কারণে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তারা।
‘আমি টানা ৯ বছর তালোড়া যুবদলের সভাপতি ছিলাম। আমাদের ভোট থেকে বঞ্চিত করেছে। এটা নির্বাচন নয় পকেট কমিটি। এটা একটা প্রহসনের নির্বাচন।’
জানতে চাইলে সাবেক আহ্বায়ক ও সভাপতি প্রার্থী রেজাউল করিম বাদশাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বগুড়া শহরের ভোটার তালিকার দায়িত্বে ছিলেন শহর বিএনপির সভাপতি হামিদুল ইসলাম হিরু। তিনি বলেন, ‘বাদ পড়ার বিষয়টি একটু ভুল বোঝাবুঝিতে হয়েছে। আমাদের ১০১টি সদস্যের কোরাম পূরণ করতে গিয়ে কয়েকজন বাদ পড়েছেন। সাবেক সম্পাদক চাঁন ভাইয়ের বাড়ি শাজাহানপুর উপজেলায়। এ জন্য আমরা মনে করেছিলাম তিনি ওই উপজেলা কমিটিতে থাকবেন। তার বাদ পড়ার খবর পেয়ে নিজের কাছেও খুব খারাপ লেগেছে। একইভাবে সংসদ সদস্য গোলাম মো. সিরাজ ভাইও বাদ পড়েছেন।’
জেলা কমিটি ১৭২ সদস্যের হলেও নির্বাচন হবে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে। এর মধ্যে সভাপতি পদে তিন, সাধারণ সম্পাদক পদে ২ ও সাংগঠনিক পদে ১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর জেলায় বিএনপির প্রকাশিত তালিকায় মোট ভোটার রয়েছেন ২ হাজার ২২ জন।’
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মামুনুর রশিদ মিঠু এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। ভোটার তালিকা থেকে তার নিজেরও নাম বাদ পড়েছে।
মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমিসহ জেলা কমিটির ৭ জন নেতার নাম বাদ পড়েছে। আর জেলায় সব মিলিয়ে অন্তত ৩০ জনের নাম ভোটার তালিকায় নেই।’
তালিকায় নাম বাদ পড়াকে ভুল বোঝাবুঝি বলে উল্লেখ করেন নির্বাচন কমিটির এ সদস্য। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের নিজেদেরও দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কোনো কারণে তালিকা প্রস্তুতের সময় যাচাই করা হয়ে ওঠেনি। এখন হাতে যে সময় রয়েছে, নতুন করে আর সংশোধন করা সম্ভব হবে না।’
তবে ভোটার সংখ্যা কমে যাওয়ায় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেন মামুনুর রশিদ মিঠু।