পার্বত্য অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।
চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা এবং কেএনএফের সব সদস্যের খাবারের খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।
শুক্রবার দুপুরে বান্দরবান র্যাব ক্যাম্পে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব তথ্য জানান র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র সংগঠনের গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এ সব তথ্য পেয়েছে র্যাব। এরা হলেন কেএনএফের সামরিক শাখার সদস্য।
বান্দরবান ও রাঙামাটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সাতজন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিনজনসহ মোট দশজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
বৃহস্পতিবার রাতে রাঙামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্বে র্যাব-৭ ও র্যাব-১৫ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন- সৈয়দ মারুফ আহমদ ওরফে মানিক, ইমরান হোসাইন ওরফে সাওন, কাওসার ওরফে শিশির, জাহাঙ্গীর আহম্মেদ ওরফে জনু, মো. ইব্রাহিম ওরফে আলী, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে বাপ্পি, রুফু মিয়া, জৌথান স্যাং বম, স্টিফেন বম ও মাল সম বম।
গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে এসবিবিএল বন্দুক ৯টি, এসবিবিএল বন্দুকের গুলি ৫০ রাউন্ড, কার্তুজ কেইস (এসবিবিএল বন্দুক) ৬২টি, আইইডি (হাত বোমা) ৬টি, কার্তুজ কেইস (এসে) ১টি, কার্তুজ বেল্ট ২টি, দেশীয় পিস্তল ১টি, বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র, ওয়াকিটকি ১টি, ওয়াকিটকি চার্জার ৩টি, কুকি-চিন স্টেটের প্রস্তাবিত ১০টি মানচিত্র ও অন্যান্য ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে মঈন বলেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া উগ্রবাদী সংগঠনে জড়িত হয়ে তারা দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কেউ নিকটাত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ স্থানীয় ব্যক্তি/পরিচিতজনদের মাধ্যমে উগ্রবাদী এই সংগঠনে জড়িত হয়। যোগদান করে কথিত হিজরতের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধাপের কর্মকেন্দ্রিক স্তর অতিক্রম করে উত্তীর্ণ হওয়া সাপেক্ষে নিখোঁজ হওয়া যুবকরা প্রশিক্ষণের জন্য আসে।
কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথাং বমের সঙ্গে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমীরের সম্পর্ক হয়।
তিনি বলেন, সংগঠনের সদস্যরা তাদেরকে উগ্রবাদে উৎসাহী করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন এলাকায় শারীরিক প্রশিক্ষণ ও তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়ার জন্য পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় জ্যেষ্ঠ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেইফ হাউসে রাখত। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ তরুণদেরকে বান্দরবানের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় পরবর্তী ধাপের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাত। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত।
মঈন বলেন, বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় পরবর্তী ধাপের প্রশিক্ষণে তাদেরকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, আইইডিসহ বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরি, চোরাগুপ্তা হামলা, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞানবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরে মোট প্রশিক্ষণার্থী ৫০-এর অধিক জানিয়ে মঈন বলেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সংগঠনটির আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, যার নেতৃত্বে উগ্রবাদী সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও, উগ্রবাদী এই সংগঠনে ৬ জন শূরা সদস্য রয়েছে যারা দাওয়াতী, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছে।
‘শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতী শাখার প্রধান, মাসকুর রহমান সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে।’
র্যাব জানায়, জঙ্গিরা অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য তারা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয়। এজন্য তারা স্থানীয় কেএনএফের সহায়তা নেয়। তারা পার্বত্য অঞ্চলের কেএনএফের কাছ থেকে তাদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করত। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করত।
গ্রেপ্তারকৃত মারুফ আহমেদ ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামি হাফেজ নাঈমের ছোট ভাই (সহোদর)। সে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে পড়ালেখা শেষ করে হাঁস, মুরগি, গবাদি পশু ও মাছের খামার পরিচালনা করত। গ্রেপ্তারকৃত মারুফ তার বড় ভাইয়ের পরামর্শে জামাতুল আনসারের শূরা সদস্য মাসুকুর রহমানের মাধ্যমে উগ্রবাদী এই সংগঠনে যুক্ত হয়।
জানা যায় যে, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন একটি উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) নামে নামকরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। হুজিবি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হওয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে সদস্য সংগ্রহ ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছিল বিধায় তারা সংগঠন থেকে বের হয়ে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে।