রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ‘ভেরিফিকেশন’ শর্তকে বড় বাধা বলে মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত জি লিমিং-এর সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘বৈঠকে মিয়ানমার কবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে এমন কোনো তারিখ জানাতে পারেননি চীনা দূত। এখনও ডেট ফিক্স হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ভেরিফিকেশনটা হলো বড় সমস্যা। সমস্যা হলো রোহিঙ্গারা যখন ফিরে আসে, তখন তো পরিবেশ অন্যরকম ছিল। তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা সব ফেলে পালিয়ে এসেছে। তারা তো কিছু নিয়ে আসতে পারেনি।
‘এখন মিয়ানমার সরকার ওদের ডকুমেন্ট চায়। তারা ডকুমেন্টের ওপর খুব জোর দিচ্ছে। বলছে, ডকুমেন্টস দেখাতে হবে। এটা বড় সমস্যা। দ্বিতীয়ত তারা যাদের অ্যাপ্রুভ করেছে, তাদের বাচ্চা অ্যাপ্রুভ করেনি। স্বামীকে অ্যাপ্রুভ করছে তো স্ত্রীকে অ্যাপ্রুভ করেনি। ফ্যামিলি ভেঙে ফেলেছে।
‘আমরা বলেছি, এসব মানি না। কারণ এটা নট সাসটেইনেবেল। চাই নিজদের আমি বলেছি, এখন আর ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। আক্ষরিক অর্থে এটা হৃদয়ের সমস্যা। ডকুমেন্টস আছে কি নেই, জাস্ট ফরগেট অ্যাবাউট ইট। এসব বিষয়েই আলাপ করেছি।’
ড. মোমেন বলেন, ‘চাইনিজ হলো ফ্যাসিলেটর। মাঝখানে কথা বলার জন্য। এখানে গুড নিউজটা বলি। মাঝখানে যে বোমা-টোমা এসে পড়ছিল, তাতে আমাদের সীমন্তবর্তী এলাকার মানুষজন আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বললাম, কাজ হলো না। তাই আমরা চাইনিজদের বললাম। এবার বন্ধ হলো।
‘এরপর তাদের বললাম- আমাদের সীমান্তে জিরো লাইনে যে ৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা আছে তা নিয়ে আমরা আতঙ্কে থাকি; কখন তারা ঢুকতে চাইবে! তোমরা এগুলো ভেতরে নিয়ে যাও। জিরো লাইনে রাখবে না। দেখা যাক কী করা যায়…।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মাঝখানে তো মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমরা বিষয়টি নিয়ে অনেককেই অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু আমরা মনে করি চায়না হলো মিয়ানমারের বড় বন্ধুরাষ্ট্র। ভালো খাতির আছে।
‘রাশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও মিয়ানমারের ভালো খাতির আছে। এর মধ্যে চাইনিজরাই প্রথম এগিয়ে আসে। তাদের উদ্যোগেই প্রথম আমরা চায়না, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ- এই তিন দেশ প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক করি।’
মোমেন বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্তমান মিলিটারি সরকার আগের সরকারের সব চুক্তিকে অনার করেছে। তারা বলেছে যে আফটার ভেরিভিকেশন রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে।
‘মিলিটারি সরকার বলেছে ওদের (রোহিঙ্গা) সেফটি ও সিকিউরিটি দেবে। এজন্য মিয়ানমারের মধ্যে পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কিন্তু এখনও সেখানে সে পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আমার মনে হয় না তাদের মধ্যে সে ধরনের কোনো ইচ্ছে আছে।’
মোমেন বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে তাদের (মিয়ানমারের বিষয়) আগ্রহ আছে। তারা আলাপ করছে কিভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে। তবে মিয়ানমারের দিক থেকে আগ্রহ অনেক কম। তারা নিজেদের সমস্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত।
‘চায়না অ্যাম্বাসেডরকে বললাম- আপনি এই প্রজেক্টটা ঝুলিয়ে রেখেছেন। এটা তো ভালো না। আমাদের কত আশা। আমরা চিন্তা করি এই হচ্ছে, এই যাচ্ছে, ওই যাচ্ছে। আপনি তো বলছেন সুখবর দেবেন। খালি বলছেন- রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য তারা এখনও এক পায়ে দাঁড়িয়ে। আগে যে অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছিল সে অনুযায়ী তারা ফেরত নেবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘উনি (চীনা রাষ্ট্রদূত) সুখবর দিতে পারেননি। বলেছেন, তিনি আশা করেছিলেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। তারা চেষ্টা করছেন।
‘আমরা ইন্ডিয়াকেও রিকোয়েস্ট করেছি। ইন্ডিয়া আমাদের বলেছে, তারা অন্যভাবে চেষ্টা করছে। কিন্তু চায়না সে ক্ষেত্রে অনেকটা নিজে থেকে এগিয়ে এসে মিটিং-সিটিং করছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাপানের সঙ্গেও মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক। আমরা তাদেরও বলেছি। জাপান আমাদের বলেছে, তারা সেখানে অনেক ঘরবাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে; যাতে রোহিঙ্গারা গিয়ে সেখানে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম চাইনিজদের মতো জাপানও মডারেটরের কাজ করুক। কিন্তু তারা সেভাবে এখনও আসেনি।
‘এটা পরিষ্কার যে জাপান… দে হ্যাভ লট অফ ইন্টারেস্ট দিস এরিয়া। তারা এখানে কী যেন করছে… বিগ বি…। তার ফলে তাদের মিয়ানমারেও বড় ইন্টারেস্ট রয়েছে।
‘জাপান সব সময়ই এ বিষয়ে আগ্রহী। কিন্তু এ বিষয়ে তিন দেশের কোনো মিটিং আয়োজন করতে আমরা এখনও দেখিনি।
প্রধানমন্ত্রী নভেম্বরের শেষে জাপান সফরে যাবেন। এই সফর উপলেক্ষে এ বিষয়ে আমরা একটি বিশেষ প্রস্তাবনা তৈরি করছি। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আমাদের একটিই প্রস্তাব- এই সমস্যা মিয়ানমার তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত নেয়াই এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। বাংলাদেশে এর সমাধান নেই।’
মিয়ানমার বন্ধুদের জন্য বাংলাদেশের বার্তা
মোমনে বলেন, মিয়ানমারের বন্ধু দেশগুলোকেও আমরা বলি- রোহিঙ্গারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কেননা এসব লোক অনেকদিন এখানে থাকলে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে। এতে তারা নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়বে। কোন কোন গোষ্ঠী তো আছেই যারা রোহিঙ্গাদের নানা প্ররোচণা দেয়। তাই দ্রুত তাদের দেশে ফেরত পাঠানোই এই অঞ্চলের শান্তির জন্য সাসটেইবেল সলিউশন।
‘আশিয়ানের অধিকাংশ দেশও বিশ্বাস করে সমস্যা সমাধানে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে। সদ্য বাংলাদেশ সফরকালে ব্রুনাইয়ের সুলতানও বলে গেছেন, তারা আসিয়ানের পজিশনেই আছেন। তারা মিয়ানমারকে ৫টি কন্ডিশন দিয়েছেন। মিয়ানমারকে তা পালন করতে হবে।’
ব্রিটিশ বিনিয়োগের ব্যাপারে কথা বলতে ‘না’
মোমেন বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক দিক বিবেচনায় যুক্তরাজ্য শুরু থেকেই আমাদের অনেক সহায়তা করেছে। সম্প্রতি আমি কিছু তথ্য পেয়েছি। ব্রিটিশরা চায় না আমি এটা বলি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার নয়, তবে ব্রিটিশ টেরিটরির অনেকেই (যেমন আয়ারল্যান্ড…) গত কয়েক বছরে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে মিয়ানমারে। এই তথ্য মিয়ানমার সরকারের। তার মধ্যে কেবল ২০২০/২১ সালেই বিনিয়োগ হয়েছে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
‘আমি ব্রিটিশ সরকারকে বলেছি- আপনারা হলেন, জেনোসাইডবিরোধী সবচেয়ে বড় শক্তি। আর আপনাদের দেশ থেকে কেমনে…। জবাবে ব্রিটিশ সরকার বলেছে- এটা আমার দেশ থেকে না, ব্রিটিশ টেরিটরি থেকে। তখন আমি বলেছি- সো হোয়াট, আপনার দেশ থেকে আর আপনার টেরিটরি থেকে….! এটা আমার কাছে খুব খটকা লেগেছে। তারা এসব নিয়ে বেশি কথা না বলতে বলেছেন।’