গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনে ১২ অক্টোবরের বাতিল হওয়া ভোটকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ দাবি করেছেন গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।
ভোটকেন্দ্রে গোপন কক্ষে অবস্থান করে ভোটারদের নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দেয়ার বিষয়টি সিসিটিভি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত জানানোর আট দিন পর গণশুনানিতে এই দাবি করলেন জেলাটির প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর প্রধান।
আগের দুই দিন দুই উপজেলায় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের ভাষ্য নেয়ার পর বৃহস্পতিবার গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে শেষ দিনের তদন্তে ৫ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, ১৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজিবি ও র্যাবের ২ জন কমান্ডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসকসহ ২৭ জনের বক্তব্য নেয় নির্বাচন কমিশনের তদন্ত কমিটি।
শুনানিতে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। আমরা আমাদের বক্তব্য দিয়েছি।’
আপনি কী বলেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ফিজিক্যালি যে জায়গাগুলো দেখেছি, সেখানে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ চলছিল। তবে মাননীয় নির্বাচন কমিশনার ভোটকক্ষের সিসিটিভির যে বিষয়টি আইডেন্টিফাই করেছেন; সেটির বিষয়ে তারা কী পেয়েছেন- সেটি ইসি পরবর্তীতে জানাতে পারবেন।’
সিসিটিভিতে অনিয়ম ধরা পড়ার পর নির্বাচন কমিশন কি তাৎক্ষণিকভাবে আপনাদের ব্যবস্থা নিতে বলেছিল?- এমন প্রশ্নে বলেন, ‘নির্বাচনের দিন আমরা অধিকাংশ কেন্দ্রই পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা যতগুলো কেন্দ্র ঘুরেছি সেখানে কোনো ধরনের সমস্যা আমরা পাইনি। পরবর্তীতে মাননীয় কমিশন যেটি আইডেন্টিফাই করেছেন; সেটির বিষয়ে অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি।’
পুরো নির্বাচন বন্ধ হওয়ার মতো কি পরিস্থিতি আসলেই সৃষ্টি হয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু কেন্দ্র ঘুরেছি। সেসব কেন্দ্রে আমরা কোনো সমস্যা দেখিনি, কিংবা অভিযোগও পাইনি। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি।’
কিন্তু ১২ অক্টোবর উপনির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবনে বসে পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন। এ সময় দেখা যায় ইভিএমে ভোটারের পরিচয় শনাক্তের পর তিনি স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারছেন না। গোপন কক্ষে উপস্থিত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি তার হয়ে ভোট দিয়েছেন বা ভোট দিতে চাপ দিয়েছেন।
অভিযোগ স্পষ্টত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দিকে। তবে নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে কার দোষে এই ঘটনা ঘটল, সেটি তদন্ত করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে। এখনও এই প্রতিবেদন আসেনি, ফলে নির্বাচন কমিশন তার করণীয়ও ঠিক করেনি।
এই তদন্তে মঙ্গলবার ও বুধবার মাঠ প্রশাসনসহ ভোট গ্রহণকারী ৫৪৯ জন শুনানিতে অংশ নেন। শুনানিতে অনেক কেন্দ্রের কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টরা বুথে বহিরাগতদের উপস্থিতি ও ভোট প্রভাবিত করার কথা কমিটির সামনে বলেছেন।
নির্বাচন কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে ভয়ভীতি দেখিয়ে লিখিত জবানবন্দি দেয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তারা শাস্তির ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি।
সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে প্রিসাইডিং অফিসাররা বলেন, ভোটের পরিবেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কেন্দ্র দখল ও প্রভাব বিস্তার ছাড়াও অন্যের ভোট জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে দিতে বাধ্য করা হয় অনেক ভোটারকে। তারপরও ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে কাগজে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘ভোটের দিন সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ চলছিল। বেলা ১২টা নাগাদ কয়েকজন সাদা গেঞ্জি পরিহিত যুবক কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। তারা ভোটদানের গোপন কক্ষে গিয়ে জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকের বাটনে চাপ দেয়।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়ার পর আমার কাছে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা আসেন। পরে জোর করে ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল; এমন স্টেটমেন্ট সাদা কাগজে লিখে নেন। আমি দিতে চাইনি। পরে আমাকে হুমকি-ধমকি দেয়া হয়।’
সামাজিক মাধ্যমে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত স্টেটমেট ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের মধ্যে সমরপাড়া দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মশিউর রহমানের একটি স্টেটমেট ছিল এমন:
‘নির্বাচনি কর্মমকর্তাসহ রির্টানিং অফিসার জনাব মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মশিউর রহমান প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে সমরপাড়া দাখিল মাদরাসার ভোট গ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে; কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোট গ্রহণ করা হয়েছে ৯০১টি। আমরা ৩ ঘটিকায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করিলাম।’
প্রার্থীরা যা বললেন
শুনানিতে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, ‘কমিশনের কাছে আমি সাক্ষ্য দিয়েছি। আমার দাবি হলো, যেসব কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা ঘটেনি, সেসব কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার দাবি জানিয়েছি।’
আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, ‘অনিয়ম পেয়ে ইলেকশন কমিশন ভোট বন্ধ করেছে। এটা একটা ভালো প্রক্রিয়া। আস্থা হওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হলে ভোটে অংশ নেব।’
তদন্ত কমিটির প্রধান যা বললেন
শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘আমরা ৬৮৫ জনকে নোটিশ করেছিলাম। সর্বমোট ৬২২ জনের বক্তব্য গ্রহণ করেছি।
‘তবে তদন্তে কী পেলাম আর কি পেলাম না- এ বিষয়ে আমরা কিছুই এখন বলব না। আগামী সোমবার আমরা রিপোর্ট ইসিতে জমা করব।’
কিছু কিছু ভোটকেন্দ্রে বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন না বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথ।
গত জুলাইয়ে জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৫ আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে এই উপনির্বাচনের শেষ করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত। উপনির্বাচনে সাঘাটা উপজেলায় ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৫৭টিসহ ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি ভোটকক্ষ স্থাপন করা হয়েছিল।
সাঘাটা উপজেলার ১০টি ও ফুলছড়ি উপজেলার সাতটিসহ ১৭টি ইউনিয়নে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৩ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৭০ হাজার ১৬০।