রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটি মাদ্রাসায় হাফেজিয়ায় পড়ে ১২ বছর বয়সী তানভীর হাসান। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকদের দৈনিক গৃহকর্মের কাজগুলোও করতে হয় তাকে।
যারা এভাবে শিক্ষকের হয়ে খাটে, তাদের বলা হয় খাদেম। সম্প্রতি মাদ্রাসায় নির্যাতনের বিষয়টি সামনে এনে প্রতিরোধের আহ্বান জানানো ধর্মীয় বক্তা রফিকউল্লাহ আফসারী শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কাজ করাতে খাদেম তৈরিরও সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, এটা ইসলাম কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।
তানভীরকে শিক্ষকদের জন্য আসলে কী কী করতে হয়?
নিউজবাংলাকে সে বলে, ‘সকালে হুজুরের বিছানা কইর্যা দেই, চা আইন্যা দেই। প্রতি সপ্তাহেই হুজুরের কাপড়ও ধুয়ে দেই। এ ছাড়া নানা কাজ করি।’
কী কারণে এসব তোমাকে করতে হয়- এমন প্রশ্নে সে বলে, ‘ওস্তাদের (মাদ্রাসায় শিক্ষককে ওস্তাদ বলেই সম্বোধন করা হয়) সম্মানে এই ধরনের কাজ করি।’
শিক্ষকরা জোর করে করায় না বলেই ভাষ্য তানভীরের।
নারায়ণগঞ্জে একটি মাদ্রাসার সামনে খেলা করছে শিক্ষার্থীরা। ছবি : নিউজবাংলা
মাদ্রাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষকের ব্যক্তিগত কাজ করাতে খাদেম বানানোর এই প্রক্রিয়া নতুন নয়। সেখানে এটি একটি রীতি হয়ে গেছে। শিশুরা ভর্তি হওয়ার পর বিষয়টি দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, যে কারণে তাদের কাছে এটি অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা মনে হয় না। ফলে তানভীরের কাছেও মনে হয় এটা স্বাভাবিক একটি বিষয়।
আবার আবাসিক কওমি মাদ্রাসায় খাদেম রাখা হলেও অনাবাসিক মাদ্রাসায় এই বিষয়টি দেখা যায় না। আলিয়া মাদ্রাসাতেও বিষয়টি নেই। সুন্নি মাদ্রাসাতেও এটি নেই।
তানভীর জানায়, সে ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ঘুম থেকে ওঠে। এরপর তালিম নিয়ে নামাজ পড়ে। পরে হুজুরের কাজ করে দেয়।
ছাত্রদের শেখানো হয়, এগুলো সওয়াবের কাজ
শিক্ষকরা ছাত্রদের খাদেম হতে উৎসাহ দেয়। তাদের ভাষ্য খাদেম হওয়াটা ছাত্রের সৌভাগ্য। এই সৌভাগ্যের বিপরীতে তাকে জামা কাপড় ধুয়ে দেয়া থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, তরকারি কাটা, বাজার করে দেয়া, এমনকি গা ম্যাসাজ করার কাজও করতে হয়।
শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কাজে ছাত্রদের মনোনিবেশে উদ্বুদ্ধ করতে যে কথাগুলো তাদের বলা হয়, তা হলো এগুলো সওয়াবের কাজ। শিক্ষকদের দোয়া পরে জীবনে কাজে আসবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শিশু মনে এই কথাগুলো গেঁথে যায়, আর তারাও তা বিশ্বাস করে কাজ করতে থাকে।
পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকদের দৈনিক গৃহকর্মের কাজগুলোও করতে হয় মাদ্রাসার শিশু শিক্ষার্থীদের। তাদের বলা হয় খাদেম। রাজধানীর একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে তোলা। ছবি: নিউজবাংলা
নারায়ণগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম দেওভোগ মাদ্রাসার নাজেরা শাখার ছাত্র নাইম বলে, ‘মাদ্রাসার প্রতিটি শাখায় হুজুরদের প্রিয় ও অপ্রিয় ছাত্র থাকে। অনেক সময় তাদের দিয়ে ঘাড় টেপানো হয়। মাথার চুল টানানো হয়। আর এটা না করার কী আছে? একজন না করলে আরেকজন করবে। কারণ, হুজুরদের খেদমত করা তো সোয়াব।’
হাফেজ শাখার ছাত্র মাহাবুব মীর বলে, যে শিক্ষক ছাত্রকে সন্তানের মতো আদর করে, তার সেবা করা যায়। তাছাড়া হুজুর যখন বলে না করার তো কোনো উপায় থাকে না।’
কী কী কাজ করে দাও তোমরা- জানতে চাইলে মিজান বিভাগের ছাত্র ইব্রাহিম বলে, ‘আমরা হুজুরদের যে খেদমত করি, তা হলো- খানা তুলে দেয়া, পানি এগিয়ে দেই, মশারি টানিয়ে দেই। হুজুররা সব সময় মাথা মালিশ করায় না, যখন মাথাব্যথা করে, তখন চুল টেনে দিতে হয়।’
কুমিল্লা গাংচর এলাকার তাহমিদুল কোরআন হিফজ মাদ্রাসার খাদেম আবদুল জলিল। হেফজ পাস করা এই যুবক বলেন, ‘ছোট শিক্ষার্থীদের দিয়ে হুজুর বা খাদেমের কাপড় ধোয়া ঠিক না। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হলে করতে পারবে।’
কেন হুজুরের কাপড় ধোয়া বা ব্যক্তিগত কাজগুলো করে দিতে হবে? এমন প্রশ্ন- তিনি বলেন, ‘আমরাও করে এসেছি। দোয়ার ব্যাপার আছে।’
এটা কি ইসলাম সমর্থন করে- এমন প্রশ্নে জবাব এলো, ‘এটা অন্যায় না।’
‘কোনো শিক্ষার্থী যদি হুজুরের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে করে দেয় সেটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন?’ বলে পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি।
রাজধানীর একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে আবাসিকের এক খুদে শিক্ষার্থী। ছবি: নিউজবাংলা।
দাবি, ছাত্ররাই আগ্রহ নিয়ে খাদেম হয়
মাদ্রাসার এ বিষয়টি যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে সে বিষয়টি খোলাশা করলেন রাজধানীর আদাবরের জামিয়া আরাবিয়া আহসানুল উলুম মাদ্রাসার শহিদুল ইসলাম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্ররা মন থেকেই শিক্ষকদের খেমদত করে। আমিও একসময় করেছি। আসলে ছাত্ররা সবাই চায় হুজুরের কাজ করার জন্য। এটা আমাদের আনন্দ দেয়।’
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় তো এমনটা দেখা যায় না। এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্ররা তো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু আমাদের এখানে কখনও দেখবেন না। সেদিন দেখলাম, এক ছাত্রের চুল কেটে দিয়েছে বলে তারা অনেক আন্দোলন করেছে। কিন্তু আমরা যদি বলি, তোমরা কাল চুল কেটে আসবে, কেউ এটা নিয়ে কিছু বলবে না। পরের দিন চুল কেটে আসবে। আমরা এখানে এমন আদব-কায়দা শেখাই। এখানে ছাত্ররা কখনও তাদের ওস্তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না।
তার দাবি, এই খাদেম পদ্ধতি নবী মোহাম্মদ (সা.) শিক্ষা। তিনি বলেন, ‘আমাদের নবী যে আদর্শ দিয়ে গেছেন সেটাই তো উত্তম আদর্শ। আমাদের নবীর খাদেম ছিলেন হজরত আনাস (র.)। তিনি মন থেকেই তার জন্য কাজ করতেন। তাকে তো টাকা দিয়ে রাসুল (সা.) কাজ করাতেন না।’
নারায়ণগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম দেওভোগ মাদ্রাসার হাফেজ খানার মোয়াদ্দিস (শিক্ষক) আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্ররা শুধু শিক্ষক নয়, নানা সময় নানা দুর্যোগে মানুষের খেতমতে এগিয়ে যায়। এটা করলেও সোয়াব আছে।’
তার দাবি, চুলটানা, ঘাড় টেপানো এখন কম হয়, আগে অনেক হতো।
‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন এগুলো বেশি হতো, এখন তো এগুলো কমে আসছে’- বলেন তিনি।
কওমি অঙ্গনেই সমালোচনা, কোথাও কোথাও কঠোর নিষেধ
হাফিজি মাদ্রাসায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সোচ্চার ধর্মীয় বক্তার নাম রফিক উল্লাহ আফসারীও এই বিষয়টির সমালোচনা করেছেন। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ওয়াজে তিনি বলেছেন, ‘ল্যাংটা পোলা (শিশু), হুজুরে হ্যাতেরে দি কুরতা (পরিধান) ধওয়ায়। হ্যাতের কুরতা ধুয়ে দেয়, … হ্যাতেরে বানাইছে খাদেম। হ্যাতেরে গা টিপবার লাই কয়। গা টেপে, হুজুরের কুরতা ধোয়। এইডার নামনি ইসলাম ব্যাটা? আল্লাহ-রসুল এইগুলা শিখায়নি।’
নারায়ণগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম দেওভোগ মাদ্রাসায় খাদেম পদ্ধতি চালু থাকলেও এর পক্ষে নন খোদ মোহতামিম (অধ্যক্ষ আবু তাহের জিহাদি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসায় শুধু শিক্ষকের খেদমত করে বিষয়টি এমন নয়। একজন জুনিয়র লোক সিনিয়রের খেদমত করতে পারে। তার মানে হলো, যদি বৃদ্ধ হলে তার লাঠিটা এগিয়ে দেয়া, অজুর পানি দেয়া, জুতাটা এগিয়ে দেয়া। যদি মুরব্বি হয় এ ধরনের খেদমত করা যায়। তবে ব্যক্তিগত শারীরিক কোনো খেদমত ইসলামে নেই। এগুলো করানো ইসলামপরিপন্থি কাজ। যারা করে থাকেন তারা ভুল করছেন।’
নারায়ণগঞ্জের দেওভোগের দারুল উলুম উম্মুল কোরআন অনাবাসিক কওমি মাদ্রাসায় কাউকে খাদেম না বানানোর নির্দেশ আছে। এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক নাছের উল্লাহ বলেন, ‘এখানে অনাবাসিক ছাত্ররা পড়ে। ছাত্রদের দিয়ে এখানে সেবা নেয়া নিষেধ। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিষেধ করে দিয়েছে।’
কুমিল্লার পুরাতন চৌধুরীপাড়ার উম্মুল কোরআন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা নাজমুস সাকিব এই খাদেম বানানোর বিরোধী।
তিনি বলেন, ‘হুজুরদের বড় বড় জোব্বা, পাঞ্জাবি ধোয়া শিক্ষার্থীদের কাজ না। তাদের দিয়ে জোর করে এই কাজগুলো করা ইসলামসম্মত নয়।
‘এখানে যেসব শিক্ষক নৈতিকভাবে স্খলিত হয়েছে তারাই এমন কাজ করবে। কখনও একটা শিশুকে ধরে মেরে কাজ আদায় করা যাবে না। লেখাপড়া তো আর জোর করে করা যাবে না।’
হুজুরদের জোব্বা ধুয়ে না দিলে শিক্ষার্থীরা মারধরের শিকার হচ্ছে, কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে, বলাৎকারের ঘটনাও ঘটছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে এই কওমি আলেম বলেন, ‘এসব ঘটনার জন্য সিস্টেম দায়ী। যদি মাদ্রাসাগুলোতে একজন শিক্ষক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ পেত, পরিপূর্ণভাবে ইসলাম চর্চা করত, ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হতো, তাহলে কখনও এসব অনিয়ম হতো না।’
তিনি বলেন, ‘এখন যে কেউ হাফেজ হয়ে নূরানী শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়ে মাদ্রাসায় চাকরি করছে। ফলে ওই শিক্ষক জানে না তার কাজ কী, কী করলে তার নৈতিক স্খলন হবে না। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কোথায় তার শিশুকে ভর্তি করাবেন- এগুলো জানতে হবে।
‘আমি এখানে কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা রুটিন করে বাংলা ও ইংরেজি শেখে। যেন একজন শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ঘটে। অভিভাবকদের বলেছি, যখন শিশু পড়তে চাইবে না তখন জোর করবেন না।
‘অনেক সময় অনেক হুজুররা ডমিনেট করে মিথ্যা ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা করে, যা মোটেও ইসলামসম্মত নয়। ইসলাম কখনও এসব শিখায় না।’
কওমি মাদ্রাসায় খাদেম থাকলেও আলিয়া মাদ্রাসায় এটি নেই বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি এলাকার কাদিরিয়া তায়্যেবিয়া তাহেরিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মুকাদ্দিস বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এটি সুন্নি মাদ্রাসা। এখানে ছাত্রদের দিয়ে হুজুররা ব্যক্তিগত কাজ করায় না। তবে কেউ যদি করিয়ে থাকে তাহলে আমার জানা নেই। তবে আমরা যারা তরুণ শিক্ষক আমরা এগুলো করাই না।’