গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপনির্বাচনে গত ১২ অক্টোবর ভোটের দিন বহিরাগত যুবকদের কাছে ‘সুষ্ঠু ভোট হয়েছে’ লিখে দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা।
বুধবার সকাল ৯টা থেকে সাঘাটা উপজেলা সম্মেলন কক্ষে দ্বিতীয় দিনের তদন্তের সময় গণশুনানিতে এ কথা জানান তারা।
এদিন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ৫২২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নির্বাচন কমিশনের তদন্ত কমিটি। এতে নির্বাচনের নানা অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির বিষয়ে চিত্র তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত কমিটির কাছে এদিন ৪০ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ২৭৮ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, ২০০ জন পোলিং এজেন্ট (প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে), সহকারী রিটার্নিং অফিসার, সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন।
গত ১২ অক্টোবর উপনির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবনে বসে পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন। এ সময় দেখা যায় ইভিএমে ভোটারের পরিচয় শনাক্তের পর তিনি স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারছেন না। গোপন কক্ষে উপস্থিত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি তার হয়ে ভোট দিয়েছেন বা ভোট দিতে চাপ দিয়েছেন।
অভিযোগ স্পষ্টত আওয়ামী লীগের নোত-কর্মীদের দিকে। তবে নির্বাচন কমিশন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে কার দোষে এই ঘটনা ঘটল, সেটি তদন্ত করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে। এখনও এই প্রতিবেদন আসেনি, ফলে নির্বাচন কমিশন তার করণীয়ও ঠিক করেনি।
সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে প্রিজাইডিং অফিসাররা বলেন, ভোটের পরিবেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কেন্দ্র দখল ও প্রভাব বিস্তার ছাড়াও অন্যের ভোট জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে দিতে বাধ্য করা হয় অনেক ভোটারকে। তারপরেও ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে কাগজে সই দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
শুনানিতে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানায়, তাদেরকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। অনেক কেন্দ্রের কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টরা বুথে বহিরাগতদের উপস্থিতি ও ভোট প্রভাবিত করার কথা কমিটির সামনে বলেছেন। সেদিন নির্বাচনি পরিবেশ ও কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। তবে, অনেকেই কৌশলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
এই নির্বাচনের ঘটনাটি তদন্তে মাঠ প্রশাসন, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাসহ ৬৮৫ জনকে তিন দিনের শুনানির জন্য তলব করে ইসির তদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার প্রথম দিন ফুলছড়ি উপজেলার ১১ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৬৬ জন সহাকারী প্রিজাইডিং অফিসার, ৫৫ জন পোলিং এজেন্ট (প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষ থেকে), গাইবান্ধা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ১৩৬ জনের শুনানি হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘ভোটের দিন সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলছিল। বেলা ১২টা নাগাদ কয়েকজন সাদা গেঞ্জি পরিহিত যুবক কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। তারা ভোটদানের গোপন কক্ষে গিয়ে জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকের বাটনে চাপ দেয়।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়ার পর আমার কাছে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা আসেন। পরে জোর করে ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল; এমন স্টেটমেন্ট সাদা কাগজে লিখে নেন। আমি দিতে চাইনি। পরে আমাকে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়।’
সামাজিক মাধ্যমে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত স্টেটমেট ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের মধ্যে সমরপাড়া দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মশিউর রহমানের একটি স্টেটমেট ছিল এমন:
‘নির্বাচনি কর্মমকর্তাসহ রির্টানিং অফিসার জনাব মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মশিউর রহমান প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে সমরপাড়া দাখিল মাদরাসার ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে; কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৯০১টি। আমরা ৩ ঘটিকায় ভোট কেন্দ্র ত্যাগ করিলাম।’
সন্ন্যাসদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘সেদিন সকাল থেকে ভোটগ্রহণ চলছিল। এরপর হঠাৎ ইসির ফোন পাই। তখন তিনি পাশের একটি কক্ষে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে সাদা গেঞ্জি পরিহিত এক যুবককে আটক করতে বলেন। পরবর্তী সময়ে আমি তাকে আটক করে আমার কক্ষে রাখি। এরপর নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয় আমার কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। আমাকে ভোটের সব সরঞ্জাম নিয়ে নির্বাচন অফিসে জমা দিতে বলেন। পরে ইসির নির্দেশে ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলাও করি।’
মজিদের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সেদিন আমার কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলছিল। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভোটে কোনো প্রভাব বিস্তার হয়নি।’
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘শুনানিতে অংশ নেয়া মাঠ প্রশাসন, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের অনেকেই ভোটের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করেছেন। আবার অনেকেই পাল্টা অভিযোগও করেছেন তদন্ত কমিটির কাছে। অনেকে সুষ্ঠু ভোটের দাবি করলেও কেউ কেউ ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ভয়ে নিরূপায়ও ছিলেন বলে জানিয়েছেন।’
বৃহস্পতিবার গাইবান্ধা সার্কিট হাউজে পাঁচ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, ১৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজিবি ও র্যাবের কমান্ডিং অফিসার দুইজন, রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার এবং জেলা প্রশাসকসহ ২৭ জনের শুনানি হবে।
গত জুলাইয়ে জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৫ আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। ২০ অক্টোবরের মধ্যে সেখানে ভোট করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে সেদিন ভোট করতে না পারাকে দৈবদুর্বিপাক হিসেবে বিবেচনা করে সংবিধানের একটি ধারা ব্যবহার করে সময় আরও ৯০ দিন বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখন আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে সেখানে ভোট করার কথা জানানো হয়েছে।