‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে চীনা রাষ্ট্রদূতের তিস্তাপাড় পরিদর্শনে বেশ খুশি রংপুর অঞ্চলের মানুষ। তার সরব আগ্রহে বছরের পর বছর বন্যা খরায় পিষ্ট মানুষজনের প্রত্যাশা, ঝুলে থাকা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ।
এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে লাভ বাংলাদেশের, বলছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এতে তিস্তা নদীর স্থায়ী সুরক্ষা হবে, তিস্তার সঙ্গে যুক্ত নদ-নদীতে ফিরবে যৌবন, রক্ষা পাবে জীব-বৈচিত্র। এ ছাড়া বাড়বে নদীকেন্দ্রিক আধুনিক কৃষি, মৎস চাষ, পর্যটন, নৌ যোগাযোগ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা। একই সঙ্গে দূর হবে এই অঞ্চলের বৈষম্য ও দারিদ্র্য।
তিস্তার ভাঙ্গন রক্ষা করা গেলে বাড়তি কোনো উৎপাদন ছাড়াই প্রতি বছর সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি অর্থমূল্যের সম্পদ রক্ষা পাবে।
সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তা নদী ও নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরে নির্মাণাধীন তৃতীয় তিস্তা সড়ক সেতু এলাকা পর্যবেক্ষণে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে নদীর সম্ভাব্যতা যাচাই, পর্যবেক্ষণ ও অগ্রগতির বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
লি জিমিং সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্পের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, এখনই উপযুক্ত সময় না হলেও আমরা আশাবাদি খুব শিগগিরিই সুসংবাদ দেয়া হবে।’
ঢাকায় ফিরে একটি সংবাদ সম্মেলনে চীনা রাষ্ট্রদূত এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে বাক্যের শুরু বা শেষে ‘তবে’, ‘কিন্তু’, ‘যদি’– এই তিনটি শব্দ যুক্ত করে কথা বলেছেন। তাই চীনা রাষ্ট্রদূতের এই ঘোষণা যেন রাজনৈতিক বক্তব্য বা রাজনীতিতে সীমাবন্ধ না থাকে সেই বিষয়টিও বাংলাদেশ সরকারকে দেখবার আহবান জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ১৭৮৭ সালের মহাপ্লাবনে ৩১৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ এই নদীর সৃষ্টি হলেও এর বাংলাদেশ অংশে প্রবাহ ১১৫ কিলোমিটার। বর্তমানে বাংলাদেশ অংশে কোথাও কোথাও ১০ থেকে ১২ মিটার প্রস্থ।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী ভারত তিস্তার পানির বিষয়ে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু তারা একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করেই চলেছে।
‘আমরা মনে করি, তিস্তা কেবল একটি নদী নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ নির্ভরতা। তিস্তা উত্তরের জীবনরেখা, কিন্তু তা আজ মরণদশায়। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা রাজনৈতিক গন্ধ খুঁজতে চাই না, এটার বাস্তবায়ন চাই।’
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুজ্জামান খান বলেন, ‘২৩৫ বছর বয়সী এই তিস্তার জন্মলগ্ন থেকেই কোনো পরিচর্যা হয়নি। তার উপর ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে অসময়ে বন্যা আর ভাঙনে জনজীবন অতিষ্ট করে তুলছে। প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়। লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। তিস্তার ভাঙ্গণে সর্বস্ব হারিয়ে আনাহারে জীবন যাপন করছে তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষ। এ থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে।’
‘নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের’ সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ‘চীনা রাষ্ট্রদূতের সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। তিস্তা নদী সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন আমরা চাই। অভিন্ন নদী হিসেবে ভারতের সঙ্গেও ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, ‘এক সময় রংপুর বিভাগসহ গোটা দেশে ভূ-উপরস্থ পানি দিয়েই সেচের কাজ সম্পন্ন হতো। এখন সেচসহ নানা কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এতে পানির স্তর প্রতি বছর ১ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নদী সুরক্ষায় নদী ব্যবস্থাপনা ও ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তা দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি রংপুর বিভাগের মানুষের কাছে উজ্জ্বল হবে।’
নদী গবেষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সব থেকে গরীব বিভাগ রংপুর। দেশে যখন গড় দারিদ্র্য ২০ শতাংশ, তখন রংপুর বিভাগে তা প্রায় ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে কড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮, গাইবান্ধায় ৪৭, রংপুর ৪৩, লালমনিরহাটে ৪২ শতাংশ। এই দারিদ্র্যের প্রধান কারণ তিস্তার ভাঙন। যত দিন তিস্তার ভাঙন রোধ হবে না, তত দিন এই জনপদ থেকে দারিদ্র্য দূর হবে না।
‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সরকার চীনের সহযোগিতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে সেটা হবে খুশির খবর। এটি যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে না হয়। প্রকৃত অর্থেই দ্রুত কাজ শুরু হয়।’
অধ্যাপক ওয়াদুদ বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। উপকূলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে কয়েক কোটি মানুষ উদ্ধাস্তু হওয়ার আশঙ্কা আছে। এর অংশ হিসেবেও তিস্তা নদী সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কারণ তিস্তার পানি ব্র্ক্ষ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হয়ে সমুদ্রে পড়ে। তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে গেলে উজান থেকে সমুদ্রে পানির চাপ কমে যায়। তাই দ্রুতই লবণাক্ত পানি উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঢুকে পড়ে। এ কারণেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে, সেটা বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিয়ার রহমান সফি বলেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি হবে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রতীক।’
তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘এটা অনেকদিন ধরে শুনে আসতেছি, কিন্তু হয় না খালি আশায় আশায় থাকি। খালি কথা বার্তায় হয় আর কাজ হয় না। এটা যদি হয়, তাহলে বন্যার সময় বাড়ি ভাঙ্গার ভয় থাকবে না। ঘর-বাড়িতে পানি উঠবে না।’
তিস্তার মহিপুর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার আলী বলেন, ‘এক পাশে পানি হইলে অন্যপাশে বালু জমে। বালুর কারণে আবাদ হয় না। শুনেছি তিস্তাত নাকি কাজ হবে। হইলে ভালো হয়, হামারগুলের দুঃখ কমে। বাপ-দাদার জমি একনাও নাই। এখন দিন আনি দিন খাই। তোমরা নদীটা বান্দি দেও তো।’
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব এটা নিয়ে কাজ করবেন। তবে আমরা এখনও কোনো নির্দেশনা পাইনি।’