গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের বন্ধ হওয়া উপনির্বাচনে ‘ব্যাপক অনিয়ম’ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তের প্রথম দিন মাঠ প্রশাসন, নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৩৬ জনের শুনানি হয়।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠন করা তদন্ত কমিটি এ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে শুনানি হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ও ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের নেতৃত্বে শুনানি হয়।
এতে অংশ নেন তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও ইসির যুগ্ম সচিব মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী এবং যুগ্ম সচিব মো. কামাল উদ্দিন বিশ্বাস।
মাঠ প্রশাসন, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই ভোটে অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করেছেন। অনেকে সুষ্ঠু ভোটের দাবি করলেও কেউ কেউ ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ভয়ে নিরুপায়ও ছিলেন বলে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন।
পোলিং এজেন্টদের অধিকাংশই নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রথম দিনের তদন্তে ১৩৬ জন উপস্থিত ছিলেন। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য নেয়া হয়েছে। তিন দিনের তদন্ত কার্যক্রম শেষে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করব। এর বাইরে এ মুহূর্তে আর কিছু বলা যাচ্ছে না।’
সেদিন ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা ও আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অনিয়ম তুলে ধরেন ফুলছড়ি উপজেলার একটি ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘ভোটের দিন কেন্দ্রে একই ধরনের সাদা গেঞ্জি পরে একসঙ্গে বেশ কয়েকজন অবস্থান নেয়। আমি বাধা দিলে তারা মারমুখী আচরণ করে। পরে পুলিশ হস্তক্ষেপে তাদের সরানো হয়।’
মঙ্গলবার সকালে গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে ইসির অতিরিক্ত সচিব ও গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের গঠিত কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। ছবি: নিউজবাংলা
আরেকটি কেন্দ্রের পোলিং অফিসার বীথি বেগম বলেন, ‘তার কেন্দ্রে শুরুতে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কার এজেন্টও ছিলেন। পরে লাঙ্গলের এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়। এরপর কোনো ভোটার এলে আঙুলের ছাপে তার পরিচয় নিশ্চিত করার পর তার ভোট গোপন কক্ষে গিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।’
বীথি বলেন, ‘ভোট শুরুর আগে দুইজন নৌকার এজেন্ট এলেন। তারপর লাঙ্গলের এজেন্টও আসেন। একপর্যায়ে কয়েকজন এসে লাঙ্গলের এজেন্টের পরিচয়পত্র কেড়ে নিয়ে তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। কয়েকজন ভোটারের আঙুলের ছাপ দেয়ার পর তাদের ভোট জোর করে নৌকায় মারেন তারা।’
ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে দাবি করে উড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল থেকে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিচ্ছিল ভোটাররা। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ ভোট বন্ধের নির্দেশ পাই। পরে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিই। আমার কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলাকালে কোনো অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলা হয়নি।’
পশ্চিম খাটিয়ামারি সরকারি প্রাথমিক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হঠাৎ ভোট বন্ধ করতে বলে নির্বাচন অফিস। এটা কেন হলো আমার জানা নেই। এমন ঘটনা নজিরবিহীন। কোনো অনিয়ম ছাড়াই ভোট বন্ধের নির্দেশ পেয়ে আমি হতবাক হয়েছিলাম।’
শুনানিতে অংশ নেয়া গাইবান্ধা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও থানার ওসি ভোট সুষ্ঠুভাবে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। তবে তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি তদন্তে অংশ নেয়া এসব কর্মকর্তা।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোট বন্ধ করে দেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
ঢাকার নির্বাচন ভবনে বসে সিসিটিভি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ করে একে একে ৫১টি ভোটকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে ইসি। পরে ভোট স্থগিত করে দেয় ইসি।
ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে এই শুনানির জন্য আদেশ জারি করে ইসির তদন্ত কমিটি। মাঠ প্রশাসন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাসহ অনেকেই রয়েছেন এই শুনানির তালিকায়।
গাইবান্ধা-৫ আসনের একটি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজে অনিয়ম ধরা পড়েছে। ফাইল ছবি
প্রথম দিনের শুনানিতে ১১ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ৬৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, ৫৫ পোলিং এজেন্ট, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ফুলছড়ির ইউএনও, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ওসিসহ ১৩৬ জনের শুনানি হয়।
বুধবার সাঘাটার ইউএনওর সভাকক্ষে ৪০ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ২৭৮ সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ২০০ পোলিং এজেন্ট, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, সাঘাটার ইউএনও, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ওসিসহ ৫২২ জনের শুনানি হবে।
২০ অক্টোবর গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে পাঁচ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, ১৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজিবি ও র্যাবের কমান্ডিং অফিসার দুইজন, রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসকসহ ২৭ জনের শুনানি হবে।
গত জুলাইয়ে জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৫ আসনটি শূন্য ঘোষণা হয়। ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে এই উপনির্বাচন শেষ করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গাইবান্ধা-৫ আসন ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত। উপনির্বাচনে সাঘাটা উপজেলায় ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৫৭টিসহ ১৪৫ কেন্দ্রে ৯৫২টি ভোটকক্ষ স্থাপন হয়েছিল।
সাঘাটা উপজেলার ১০টি, ফুলছড়ি উপজেলার সাতটিসহ ১৭টি ইউনিয়নে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন।