‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের’ আওতায় বাঘ গণনার ও বাঘের বংশ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল বন বিভাগ। তবে অর্থছাড় না হওয়ায় ওই প্রকল্পটি আটকে আছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৩ মার্চ এ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মেয়াদ ছিল চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত।
বন বিভাগের ধারণা ছিল মে মাসের শুরুতে প্রকল্পের অর্থ পাওয়া যাবে। তবে গত পাঁচ মাসেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির কোনো অর্থ ছাড় দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, ‘প্রকল্পটি আমাদের বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকলেও টাকা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে তারা টাকা দিচ্ছে না। সেই কারণে আমরা বাঘ গণনাও করতে পারছি না। এর জন্য আমাদের মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোনো ত্রুটি নেই। দায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের।’
বন বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে ৩ হাজার ৮৪০টি বাঘ প্রকৃতিতে টিকে আছে। তার মধ্যে ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘ আছে ১১৪টি, যা ২০১৫ সালে ছিল ১০৬টি ও ২০০৪ সালের জরিপে ছিল ৪০৪টি।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘সম্প্রতি সুন্দরবনে বারবার বাঘ দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। তবে গণনা না করে বাঘের বর্তমান সংখ্যা বলা তো সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘সুন্দবনের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে বাঘের গুরুত্ব সব থেকে বেশি। এই প্রকল্পটি মূলত বাঘের বংশ বৃদ্ধির জন্য নেওয়া হয়েছিল। তবে অর্থ না পাওয়ায় আটকে আছে।’
কী আছে প্রকল্পে?
মিহির কুমার দো জানান, এ প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনে বাঘ গণনা করা, বাঘ গণনার জন্য আবাসন লঞ্চ ও সাপোর্ট বোট চার মাসের জন্য ভাড়া করা, ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনার জন্য ২০০টি বিশেষ ক্যাটাগরির ক্যামেরা সংগ্রহ, ব্যাটারি, এসডি কার্ড কেনা, জরিপ দলে অনিয়মিত শ্রমিক, ট্রলারচালক ও জরিপের সব কার্যক্রম পরামর্শক বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরিচালনা, জরিপ দলের সব সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান, উপাত্ত সংগ্রহ ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য ৩ কোটি ২৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল।
এ ছাড়া প্রকল্পের বাকি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল বাঘ সংরক্ষণের জন্য। তার মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের ৩৪০ জন সদস্য ও চারটি রেঞ্জের কমিউনিটি পেট্রল গ্রুপের ১৮৫ জন সদস্যকে প্রশিক্ষণ প্রদান, তাদের পোশাক সরবরাহ ও প্রতি মাসে বনকর্মীদের সঙ্গে মাসিক সভা করা।
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘের ৮০ শতাংশ খাবার আসে হরিণ থেকে। এই প্রকল্পের আওতায় বাঘের শিকার হরিণ, বন্য শূকর– এ ধরনের প্রাণীর জরিপ করার উদ্যোগ ছিল।’
এ ছাড়া বংশ বৃদ্ধির জন্য পুরুষ ও নারী বাঘকে কাছাকাছি রাখার জন্য বাঘ হস্তান্তর, তাদের বিচরণ এলাকা জানার জন্য দুটি বাঘে স্যাটেলাইট সংযুক্তি ও মনিটর করা, বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি এবং মাত্রা নির্ণয়, উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ কার্যক্রম এ প্রকল্পটির করার কথা রয়েছে।
মিহির কুমার দো বলেন, ‘বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন প্রায় প্রতি বছর আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের যে অংশে আগুন লাগার প্রবণতা বেশি, সে জায়গায় দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ ও সুন্দরবনে আগুন লাগলে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানো যায়, আগুন নেভানোর যন্ত্রাংশ, পাইপ ও ড্রোন ক্রয় কার্যক্রমও এ প্রকল্পের মাধ্যমে করা হবে।
‘সুন্দরবনে গ্রামসংলগ্ন এলাকায় নদী ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বাঘ গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের হুমকি হয়ে থাকে। এ জন্য ৬০ কিলোমিটার অংশে নাইলনের ফেনসিং নির্মাণ করে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।’
তিনি জানান, সুন্দরবনে ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও ২০২১ সালে ইয়াসের মতো বড় বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বনের সব এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন বনের বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণী আশ্রয়ের জন্য লোকালয়ে প্রবেশ করে। বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণী ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়ের জন্য সুন্দরবনে ১২টি মাটির কিল্লা স্থাপন করা হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
এ ছাড়া বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের সব কার্যক্রমে পরামর্শক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে বিশেষ প্রশিক্ষণ, জরিপ সম্পন্ন, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, প্রতিবেদন তৈরি কার্যক্রমে স্বল্পমেয়াদি ১২ জন পরামর্শক বিশেষজ্ঞের সংস্থান প্রকল্পে রাখা হয়েছে।