বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিদ্যুতের চেয়ে পানির দাম বেশি

  •    
  • ১৭ অক্টোবর, ২০২২ ০৮:২৬

খুলনায় ওয়াসার পানির দাম এখন ৮ টাকা ৯৮ পয়সা। আর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। পানির এই উচ্চমূল্যের পাশাপাশি সেবা নিয়ে রয়েছে অসন্তুষ্টি।

খুলনা ওয়াসা নতুন মূল্য নির্ধারণ করায় প্রতি ইউনিট পানির দাম বিদ্যুতের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। ফলে শহরের অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ওয়াসার পানি ব্যবহারে অনীহা দেখা দিয়েছে। ওয়াসার বিরুদ্ধে লবণাক্ত ও ময়লাযুক্ত পানি সরবরাহের অভিযোগেরও কোনো সুরাহা হয়নি।

খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য ১৪ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে সার্ভিজ চার্জ, ডিমান্ড চার্জ ও ভ্যাট।

খুলনা শহরে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)। ২০২০ সালের নির্ধারিত দামে তারা গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে।

ওজোপাডিকো সূত্রে জানা গেছে, আবাসিকের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সর্বনিম্ন মূল্য ৩ টাকা ৭৫ পয়সা, কৃষিকাজের জন্য ৪ টাকা ১৬ পয়সা, শিক্ষা-ধর্মীয়-দাতব্য প্রতিষ্ঠান-হাসপাতালের জন্য ৬ টাকা ২ পয়সা, রাস্তার বাতি-পানির পাম্পের জন্য ৭ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা আছে।

বাণিজ্যিকভাবে ক্ষুদ্রশিল্পের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৫৩ পয়সা, নির্মাণশিল্পের জন্য ১২ টাকা, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের জন্য ৭ টাকা ৬৪ পয়সা ও অফিসের জন্য ১০ টাকা ৩০ পয়সা।

খুলনা ওয়াসা ও ওজোপাডিকোর মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আবাসিকের জন্য প্রতি ইউনিট পানির দাম বিদ্যুতের থেকে ৫ টাকা ২৩ পয়সা বেশি। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রতি ইউনিট পানির দাম বিদ্যুতের থেকে ৪ টাকা ৩০ পয়সা বেশি।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম ডেভিড বলেন, ‘একদিকে ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে বৈদ্যুটিক পাম্প ছাড়া বহুতল ভবনের ট্যাংকিতে ওয়াসার পানি ওঠানো সম্ভব হয় না। ফলে পানি তুলতে ওয়াসাকে একদিকে মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিল আসছে। যে কারণে ওয়াসার পানিতে মানুষ সন্তুষ্ট নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বছরে ৩ মাস ওয়াসার পানি লবণাক্ত থাকে। কারণ তারা মধুমতী নদীর পানি এনে শহরে সরবরাহ করে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মধুমতীতে লবণ পানি থাকে। ওয়াসা অন্য সময়ের রিজার্ভ করা পানির সঙ্গে ওই তিন মাস লবণ পানি মিশিয়ে বিক্রি করে, যা গ্রাহকের সঙ্গে এক রকম প্রতারণা। এই পানি মানুষের ব্যবহারের যোগ্য নয়। এমনকি ছাদের গাছপালাকেও দেওয়া যায় না।’

এ প্রসঙ্গে খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ্‌ বলেন, ‘পানির দাম আমরা ইচ্ছা করে বাড়াইনি। ওয়াসার পানি আনা হয় শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূর থেকে। সেই পানি রিফাইন করতে প্রতি ইউনিটের জন্য ১৬ টাকা করে খরচ হয়। সম্প্রতি মূল্য বাড়ানো হলেও সরকার এখনো পানির দামে ভর্তুকি দিচ্ছে।’

পানির লবণাক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বছরের কিছু সময়ে পানি লবণাক্ত ছিল। তবে এখন আমরা পুকুরে পানি রিজার্ভ রেখে দিচ্ছি। যখন মধুমতীর পানি লবণ হয়ে যাবে, তখন রিজার্ভ পানি সরবরাহ করা হবে।’

পানিতে ময়লা বা দুর্গন্ধ থাকে– এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘খুলনা শহরে ড্রেন, রাস্তা ও টিএনটি লাইন সংস্কারের জন্য বারবার খনন করা হয়। ফলে অনেক সময়ে ওয়াসার পাইপ ফেটে যায়। তখন পানিতে ময়লা মিশতে পারে। তবে তা আমরা দ্রুত মেরামত করে সমস্যা সমাধান করে থাকি।’

পানির দাম বাড়ে গ্রাহকের মতামত ছাড়া

খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ বছরে ৫ দফা পানির দাম বাড়িয়েছে সংস্থাটি। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি ৪ টাকা ইউনিট ধরে পানির নতুন মূল্য তালিকা অনুমোদন করে ওয়াসা বোর্ড।

২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে পানির দাম দাঁড়ায় প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পানির দাম আরও ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে ইউনিটপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৫ টাকা ৭৬ পয়সা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আরও ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে ওয়াসা। এতে প্রতি ইউনিট পানির দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬ টাকা ৯১ পয়সা।

গত আড়াই বছর এই মূল্যই কার্যকর ছিল। সর্বশেষ চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর পানির দাম বাড়ানো হয়।

কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই পানির মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় ক্ষুব্ধ খুলনার নাগরিক নেতারা। তাদের দাবি, আইন অনুযায়ী সেবার দাম বৃদ্ধির আগে অবশ্যই গণশুনানি করতে হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নামক সংগঠনের খুলনা জেলা শাখার সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, ‘গ্রাহকদের মতামত ছাড়া ওয়াসা এভাবে পানির দাম বৃদ্ধি করতে পারে না। আয় বাড়ানোর জন্য পানির দাম না বাড়িয়ে ওয়াসার উচিত নিজেদের খরচ কমানো।’

ক্যাবের খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম ডেবিড বলেন, ‘পাঁচ দফা দাম বাড়ানো হলেও ওয়াসা কখনও গ্রাহকের মতামত নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা স্পষ্ট ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন।’

এ প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘অন্যান্য শহরের তুলনায় খুলনা ওয়াসার পানির দাম কম। এই দাম দিয়ে কর্মকর্ত-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যায় না। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। প্রতি বছরই এই ভর্তুকি কমছে।

‘সর্বশেষ পানির মূল্যবৃদ্ধি ও নিজস্ব আয় না বাড়ালে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ জন্য ওয়াসার বোর্ড সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।’

পানি পান না হতদরিদ্ররা

খুলনা শহরের ৫ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তি একালায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের বাসবাস। তবে তাদের পানির চাহিদা পূরণ করতে অনীহা ওয়াসার।

কেসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘গত বছর বস্তির একটি টিউবওয়েলের পাইপ ফেটে গিয়েছিল। প্রথমে ওয়াসার কর্মকর্তাদের কাছে যাই। তারা আশ্বাস দিয়েও কাজ করেনি। পরে আমি নিজে ওয়াসার এমডির কাছেও গেলাম, তিনি অভিযোগ শুনলেন, সমস্যার সমাধান করলেন না। একবার মেয়রকে দিয়েও তাকে বলিয়েছি, তবুও কাজ হয়নি। পরে নিজের টাকায় সেই টিউবওয়েল ঠিক করে দিছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসার এমডি আমাকে বলেছেন ওয়াসা সেবা দেয় না, ব্যবসা করে। ওয়াসা নাকি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাদের এই ব্যবসার দরকার নেই। আমরা আগে সেবা চাই।’

কেসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ সামছুউদ্দীন আহমেদ প্রিন্স বলেন, ‘প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে খুলনা ওয়াসা পানি সরবরাহে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু এতে পর্যাপ্ত সেবা মিলছে না। আমি কাউন্সিলর হয়েও আবেদন করে বাড়িতে পানির সংযোগ পাইনি। আমার বাড়ির দলিলসহ সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। তারা সেই করোনা কালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমাকে ঘোরাচ্ছেন। আজ দিব, কাল দিব এভাবেই দুই বছর চলছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি নিজে সিটি করপোরেশনের পানি ব্যবস্থাপনার স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি। ওয়াসা যখন পানির লাইনের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছিল, তখন খুব আশায় ছিলাম, পানির সমস্যা লাঘব হবে। তাদের কাছ থেকে আমি নিজেই সেবা পাচ্ছি না, বস্তির মানুষ কীভাবে পাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াসা মিটার বসিয়েছে। যাদের এক ইঞ্চি মোটা পাইপ দিয়ে পানির সংযোগ দেয়া হয়েছে, তাদের দেড় ইঞ্চি পাইপের বিল করে দিচ্ছে। কোথাও দেখা যায় পরিবারে তিনজন সদস্যের জন্য পানির বিল ২ হাজার টাকার বেশি হয়েছে। এমন অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘বস্তি এলাকায় আমরা পাইপলাইনের মধ্যে পানি না দিলেও সেখানে টিউবওয়েল রয়েছে। সেখান থেকে বস্তিবাসীর পানির চাহিদা পূরণ হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ওয়াসা এখনও শহরের শতভাগ মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। এ ছাড়া যেসব বাড়ির কেসিসির হোল্ডিং নম্বর নেই, তাদের আমরা পানির সংযোগ দিই না।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা

২০২০ সালের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ময়ূর নদ হতে পারে খুলনা শহরের পানির চাহিদা পূরণের সেরা মাধ্যম।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ময়ূর নদটি খুলনার আলুতলা থেকে শুরু হয়ে শহরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে বিলপাবলা এলাকা পর্যন্ত বয়ে গেছে। সেখানে প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার জায়গা রয়েছে। খুলনা শহরে প্রতি বছর ২ হাজার থেকে ৩ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।

এই গবেষণা দলের নেতৃত্বে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলিপ কুমার দত্ত।

তিনি বলেন,‘এই নদটি সংস্কার করে বর্ষা মৌসুমে স্বাদু পানি ধরে রাখা যেতে পারে। সেই পানি দিয়ে শহরের মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো যাবে। এটা ওয়াসাকে বারবার বলা হলেও তারা কখন আমলে নেইনি।’

খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, ‘একসময়ে খুলনা শহরের মানুষের জন্য সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করত কেসিসি। তখন কোনো অভিযোগ ছিল না। এখন ওয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগের অভাব নেই। কী কাজে তারা ৫২ কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে যাবে? শহরের পাশের নদী থেকে পানি রিফাইন করলেই তো লবণ পানিকে মিষ্টি করা যায়। তাদের সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই।’

এ বিভাগের আরো খবর