আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে চলবে বলে বিএনপির কয়েকজন নেতার পক্ষ থেকে বক্তব্য এলেও এই দিনটিকে ঘিরে দলটির কোনো বিশেষ পরিকল্পনা নেই।
২০০৪ সালে বিএনপিবিরোধী দলে থাকার সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের পক্ষ থেকে ৩০ এপ্রিলের যে ডেডলাইন এসেছিল, এটি অনেকটা তেমনই।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান প্রথমে কথাটি তুলেছিলেন, দলের প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী পরে সেটি আবার বলেন, চট্টগ্রামে বিভাগীয় যে সমাবেশকে বিএনপির আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, সেখানেও এই বিষয়টি তোলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন।
তবে বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিশ্চিত করেছেন, এসব বক্তব্য কথার কথা মাত্র। কোনো নির্দিষ্ট দিনকে ঘিরে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।
দশম সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংস আন্দোলনের পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সেই নির্বাচনে এক বছর পূর্তির দিন প্রস্তুতি ছাড়া অবরোধ ডেকে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে।
এরপর থেকে আর হুটহাট করে কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি। এমনকি যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করে একমত হওয়ার পরেও এবার তাড়াহুড়ো নেই দলটির। এবার দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু করছে, কিন্তু কবে থেকে কর্মসূচি, কী ধরনের কর্মসূচি, সেটি বলছে না তারা। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলছেন, ‘সময় এলেই সব জানানো হবে।’
১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফাইল ছবি
১০ ডিসেম্বর নিয়ে আমানের বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন রাখলে মির্জা ফখরুল একে ‘বাজে কথা’ বলে উড়িয়ে দেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এসব বাজে কথা নিয়ে আমাকে প্রশ্নে করবেন না। পলিসি মেকিংয়ে আমান সাহেব কেউ না। এটা পলিটিক্যাল রেটোরিকস (রাজনৈতিক কথার কথা)’
যেভাবে এলো ১০ ডিসেম্বর প্রসঙ্গ
গত ৮ অক্টোবর রাজধানীতে এক আলোচনায় একই রকম একটি ডেডলাইন দেন আমান। তিনি সেদিন বলেন, ‘এই বাংলাদেশ চলবে না, এই বাংলাদেশ চলবে আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে চলবে খালেদা জিয়ার কথায় ও দেশনায়ক তারেক রহমানের কথায়। এর বাইরে কোনো দেশ চলবে না কারও কথায়।’
দুইদিন পর লক্ষ্মীপুরে এ্যানী বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ১০ তারিখের পর দেশনেত্রীর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ চলবে। আর কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না।’
চট্টগ্রামে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে নেতাকর্মীরা। ফাইল ছবি
তারও দুইদিন পর মীর নাছির চট্টগ্রামে তাদের সমাবেশে বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশে খালেদা জিয়ার সরকার চলবে। যারা খালেদা জিয়াকে আবার কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। চট্টগ্রাম থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হলো।’
আমান কী বলছেন
১০ ডিসেম্বর সময় বেঁধে দিয়ে রাজনৈতিক হুংকার দেয়ার বিষয়ে নিউজবাংলার প্রশ্নে আমান উল্ল্যাহ আমান স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তিন দিনের চেষ্টায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ রয়েছে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষও জেগে উঠেছে। এই সরকারকে জনগণ চায় না। এর পতন হবেই। দিন তো ফুরিয়ে এসেছে।‘
আপনি যে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে, তার মানে তিনি কি রাজনীতি নিয়ে আবার কথা বলবেন না কোনো নির্দেশ দেবেন?- এমন প্রশ্নেও আমানের স্পষ্ট জবাব পাওয়া গেল না।
রাজধানীতে বিএনপির এক সমাবেশে দলের নেতা আমানউল্লাহ আমান।
তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া হলো দেশের নেত্রী জনগণের নেত্রী। জনসাধারণের আশা-ভরসা। শেখ হাসিনা সরকারের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে জনগণ বেগম জিয়ার দিকে তাকিয়ে আসছে। নদীর স্রোত কখন কোন দিকে যায় তা তো বলা যায় না।’
তাও আমানের সঙ্গে কথা বলা গেছে। এ্যানীর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে কথা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। বিএনপি নেতারা সচরাচর মোবাইল ফোনে কথা বলতে চান না। তারা স্বাচ্ছ্বন্দ বোধ করেন হোয়াটসঅ্যাপে।
২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়ার দুই বছর পর প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে ২০২২ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর রাজনীতি নিয়ে তিনি কোনো কথাই বলছেন না। এমনকি জাতীয় দিবস বা ধর্মীয় উৎসবের দিনেও দেশবাসীর উদ্দেশে কোনো বার্তা দিচ্ছেন না।
এ্যানীর হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে কল করেও কোনো লাভ হয়নি। রিং বাজার পর তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ম্যাসেজ পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির কর্মসূচি আছে
১০ ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন নিয়ে বিএনপির বিশেষ পরিকল্পনা না থাকলেও সেদিন রাজধানীতে তাদের সমাবেশের ঘোষণা আছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সমাবেশের মধ্য দিয়ে দেশের সব সাংগঠনিক বিভাগে মহাসমাবেশ শুরু করেছে বিএনপি। এই পর্বের কর্মসূচি শেষ হবে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে।
এই সমাবেশেই পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। সেদিন থেকেই যুগপৎ কর্মসূচি শুরুর চেষ্টা থাকবে। তবে যদি অন্যান্য দলের সে রকম প্রস্তুতি না থাকে, সেক্ষেত্রে এককভাবেই রাজপথে ধারাবাহিক থাকবে বিএনপি।
সেদিন বিশ্ব মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে এই কর্মসূচির আয়োজনের চেষ্টা থাকবে। এই দিবসটি দলটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করছে এ কারণে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে মানবাধিকার ইস্যুতে ঘায়েল করতে চায় তারা।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে বিএনপি এই বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, বিরোধী দলেল নেতাকর্মীদের গুমের সঙ্গে সরকার জড়িত।
বিরোধী দলে থাকতে এমন ঘোষণা ছিল আ.লীগেরও
আমান, এ্যানী ও নাছির একটি দিনকে ঘিরে বক্তব্য রেখে যে আলোড়ন তুলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটি নতুন কিছু নয়।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার দিন বছর পর এভাবে একটি ডেডলাইন দিয়ে তুমুল আলোচনা তৈরি করেছিলেন আওয়ামী লীগের সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ শেষে হঠাৎ করেই তিনি ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন হবে বলে ঘোষণা দেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল। ছবি: সংগৃহীত
সে সময় পদত্যাগী রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নতুন দল গঠন, বিএনপিতে থেকে অলি আহমেদের নানা তৎপরতা এবং পর্দার আড়ালে আরও নানা কিছু ঘটছিল। যে কারণে জলিলের ৩০ এপ্রিলের ডেডলাইন নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়।
সে সময় রাজপথে এবং ঘরোয়া পরিবেশে নানা কর্মসূচি দিতে থাকে আওয়ামী লীগ এবং সমমনারা। বিএনপিতে উদ্বেগও ছিল স্পষ্ট।
তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ৩০ এপ্রিলকে ঘিরে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিও ছিল না, তেমনি রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার মতো কোনো ঘটনাও ঘটেনি। পর্দার আড়ালে কিছু হওয়ার কথা ছিল কি না, সেটি আর কখনও প্রকাশ পায়নি।