বরিশালের বাবুগঞ্জে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের জন্য ব্যবহার করা ট্রলার পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার শুক্রবার বিকেলে জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
তদন্ত শুরুর বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মো. রফিকুল ইসলাম জানান, এখনও চিঠি হাতে পাননি। তাছাড়া আগামী ১৭ অক্টোবর ভোট। ঘটনার সময় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ভোটার। একারণে ভোট শেষ হওয়ার পর তদন্ত শুরু করতে হবে।
বাবুগঞ্জ খেয়াঘাট এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ট্রলারটি পুড়িয়েছেন। যদিও ইউএনও নুসরাত ফাতিমা একে আখ্যা দিয়েছেন ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে।
ট্রলারের মাঝি ও মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ট্রলার ভাড়া করে নিছিলেন ইউএনও ম্যাডাম। আমারে ভালো না লাগলে ছাইড়া দেবে।
‘আমার ট্রলার পোড়ানোর তো দরকার ছিল না। আমি এখন পথে বইসা গেছি।’
তিনি জানান, গত ১৪ বছর ধরে বিভিন্ন অভিযানিক দলের সদস্যদের পরিবহন করছেন। বৃহস্পতিবার অভিযান শেষে তীরে ভিড়তে নিষেধ করার বিষয়টি জানানোর জন্য মৎস্য কর্মকর্তা ফোন করেছিলেন, কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দে কল শুনতে না পাওয়ায় তা রিসিভ করতে পারেননি।
আনোয়ার আরও জানান, ট্রলার ঘাটে ভেড়ার পর মৎস্য কর্মকর্তা ও ইউএনও তাকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করেন। তখন তিনি ট্রলার থেকে চলে যান। পরে ইউএনও তার ট্রলারে আগুন দিয়েছেন। ট্রলারটি ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছিলেন।
কী বলছেন ইউএনও
এ বিষয়ে বাবুগঞ্জের ইউএনও নুসরাত ফাতিমা বলেন, ‘আমরা আনোয়ারের ট্রলার ভাড়া করেছি। তার ট্রলার পুড়িয়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অভিযানে জব্দ হওয়া কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি, ট্রলার নয়। আর আমি যখন জব্দ হওয়া মাছগুলো এতিমখানায় দিচ্ছিলাম, তখন ট্রলারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ট্রলার তো আমি জব্দ করিনি, ট্রলারটিতে আগুন লাগার বিষয়টি দুর্ঘটনা এবং সেটি নেভানোর জন্য আমি চেষ্টা করেছি।
‘ফায়ার সার্ভিস এসেছিল। তারা আগুন ধরানো কারেন্ট জালে পানি দিচ্ছিল। সে সময় তাদের বারণ করেছি কারেন্ট জালে যাতে পানি দেয়া না হয়। কেননা সেটি জব্দের পর পোড়ানো হচ্ছিল।’
নুসরাত ফাতিমা বলেন, ‘কারেন্ট জাল পোড়ানোর নির্দেশের বিষয়টি অন্যভাবে রিপ্রেজেন্ট করা হচ্ছে। আমি যে ট্রলার ভাড়া করেছি, অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষ যেটি ভাড়া করেছে, সেটি পুড়িয়ে ফেলে আমারও কোনো লাভ নেই, রাষ্ট্রেরও কোনো লাভ নেই। একটি স্বার্থান্বেষী মহল মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাধাগ্রস্ত করতে অপপ্রচার করছে।
‘যার ট্রলারটি পুড়ে গেছে, সে গত ৫-৬ দিন যাবৎ রাত-দিন আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। ক্ষতিপূরণের জন্য তার পাশে দাঁড়াব আমরা।’
ইউএনওর উপস্থিতিতে পোড়ানো হয় ট্রলার: এসআই
অভিযানে উপস্থিত বাবুগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হান্নান মিঞা বলেন, ‘ট্রলার কেন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেটা ইউএনও মহোদয় ভালো বলতে পারবেন। অভিযান শেষে ট্রলার নিয়ে আমরা বাবুগঞ্জ খেয়াঘাটে আসি। এরপর ট্রলার থেকে জাল এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর জব্দ হওয়া মাছ নিয়ে উপরে উঠি।’
তিনি বলেন, “যখন জাল পোড়ানো হচ্ছিল, তখন ট্রলার মাঝি আনোয়ারকে ইউএনও মহোদয় জিজ্ঞাসা করেন, ‘আনোয়ার, তোমার ট্রলারে ছোট মাছ কেন, বড় মাছ কই?’ তখন আনোয়ার বলছে, ‘আমার ট্রলারে বড় মাছ পাওয়া যায়নি।’ এরপর আনোয়ারের ট্রলারের ডালার নিচে একটা ভাঙা বৈঠা হাতে নেন ইউএনও মহোদয়।
“পরে আনোয়ারকে ডাকাডাকি করেও আর পাওয়া যায়নি। জাল পোড়ানো শেষে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও মহোদয় ওপরে উঠে এসে তিনটি এতিমখানায় জব্দকৃত ইলিশ বিতরণ করেন।”
হান্নান মিঞা বলেন, ‘ইলিশ বিতরণ শেষে ইউএনও মহোদয়ের উপস্থিতিতে তার দুইজন আনসার সদস্য আনোয়ারের ট্রলারে ওঠে, ট্রলারে থাকা ডিজেল ট্রলারে ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।’
এসব কথা পুরো বানোয়াট দাবি করে ইউএনও নুসরাত ফাতিমা বলেন, ‘আনসার সদস্যরা আমার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা কেন আমার নির্দেশে একটি ট্রলারে আগুন ধরাবে?’
আনসার সদস্য-ওসির ভাষ্য
অভিযানের সময় নুসরাত ফাতিমার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্য মামুন হাওলাদার বলেন, ‘জব্দকৃত মাছ যখন বিতরণ করা হচ্ছিল, তখন আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি ট্রলারে আগুন জ্বলছে। ইউএনও স্যারকে আমি দেখিয়েছি আগুনের চিত্র। ট্রলারটিতে একটি গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। তাই আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল।’
অপর আনসার সদস্য সুকদেব দাস বলেন, ‘ইলিশ বিতরণের ছবি তুলছিলাম আমি। এর মধ্যে মামুন এসে ট্রলারে আগুনের কথা বলে।
‘আমরা ট্রলারে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলাম। আমার মনে হয় ইউএনও স্যারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বাবুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরের পর উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও আমাদের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নদীতে অভিযানে নামেন। সন্ধ্যার পর তারা অভিযান শেষ করে তীরে ফিরে জব্দ হওয়া কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ফেলে, পাশাপাশি কিছু মাছ এতিমখানায় বিতরণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে যে ট্রলারে করে অভিযান চালানো হয়, সেই ট্রলারের মাঝিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। একপর্যায়ে ওই মাঝি ভয়ে পালিয়ে যায়। পরে ইউএনও সাহেবের সঙ্গে দেহরক্ষী আনসার সদস্যরা ট্রলারটিতে ডিজেল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে।
‘আমি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয় ঘটনাস্থল গিয়ে ট্রলারটি পুড়ে যাওয়ার বীভৎস চিত্র দেখতে পাই। ফায়ার সার্ভিসকে যেতে বলেছিলাম। ফায়ার সার্ভিসকে ইউএনও মহোদয় বলছেন, মোবাইল কোর্টের আলামত পোড়ানো হচ্ছে, তবে আমাদের জানা মতে কোনো মোবাইল কোর্ট হয়নি।’
ওসি আরও বলেন, ‘ট্রলার পুড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ আসেনি। ট্রলার মালিক বা মাঝি কেউ আমার কাছে আসেনি।
‘আমাদের কাছে যদি কোনো অভিযোগ আসে, তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
কী বলছে ফায়ার সার্ভিস
বাবুগঞ্জ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন অফিসার আব্দুল মালেক বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা (রাত) ৯টা ৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে গিয়ে দুইটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অজ্ঞাত।’
বাবুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী ইমদাদুল হক দুলাল বলেন, ‘অভিযান শেষে ট্রলারের মাঝি জব্দ মাছের কিছু বড় ইলিশ সরিয়ে রাখে। এটিই ইউএনওর রাগের কারণ।
‘ইউএনওর নির্দেশনা ছিল অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও ট্রলার ভেড়াবে না। মাঝি সেটা করেছে। এই কারণে ইউএনও আইনগতভাবেই আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।’
অপরদিকে বাবুগঞ্জের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, মা ইলিশ রক্ষা অভিযান নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে নীরব দ্বন্দ্ব চলছিল। ট্রলারের মাঝি আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে জব্দ হওয়া ইলিশ বিভিন্ন স্থানে বিক্রির খবর ছিল উপজেলা প্রশাসনের কাছে। আর মাঝি আনোয়ার কাজ করতেন বাবুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী।