সারা বছর নদ-নদীর তীব্র ভাঙনে কুড়িগ্রাম জেলা এখন হুমকির মুখে। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে জেলার মানচিত্র। ভাঙনে গৃহহীন হয়ে পড়ছে হাজারও পরিবার। শুধু কর্মহীনই হয়ে পড়ছে না তারা, হয়ে পড়ছে নিঃস্ব। কুড়িগ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ১৬টি নদ-নদীর কারণে এখানে ৩১৬ কিলোমিটার নৌপথ। পাঁচ শতাধিক চরাঞ্চল রয়েছে এ জেলায়।
প্রতি বছর নদ-নদীর পানি বাড়া-কমার সঙ্গে ভাঙন অব্যাহত থাকে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানো মানুষের বুক ফাঁটা আহাজারিতে ভারি হয়ে থাকে নদীতীরবর্তী জনপদগুলো। খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় ভাঙনকবলিতদের।
সবচেয়ে বেশি ভাঙন তিস্তা, ধরলা, গঙ্গাধর, দুধকুমার নদ ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। একের পর এক গ্রাম বিলীন হয়ে যায় নদীগর্ভে। শত শত বিঘা আবাদি জমি, কাঁচা-পাকা সড়ক, মসজিদ, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা এবং গাছপালা হারিয়ে যায় প্রতি বছর। ক্ষতিগ্রস্তরা থাকার জায়গা না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ফকিরপাড়ার বাসিন্দা আফিয়া বেওয়া বলেন, ‘বেশ কিছুদিন হইল দুধকুমার নদীতে ঘরবাড়ি ভাঙ্গি গেইছে। কিছু জিনিস সরবার পাইলেও অনেক জিনিস ভাসি গেইছে। সেই কি নদীর ভাঙন। চোখের পলকে সব ভাসি গেইল।’
সোলায়মান আলী বলেন, ‘মাস দেড়কের মধ্যে ফকিরপাড়া আর মুন্সিপাড়া বিলীন হয়া গেইছে। ৩০০ থেকে ৪০০ পরিবার নিঃস্ব। তাদের থাকারও জায়গা নাই। যে যেখানে পাইছে, আশ্রয় নিছে। এখন হামার কাজ নাই, হাতত টাকা নাই। হু-হু করি জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এখন এই মানুষগুলা বাড়ি করবে না প্যাট বাঁচাইবে। এই চিন্তায় নদীভাঙনকবলিতরা অসহায় হয়া গেইছে।’
আব্দুল জলিল বলেন, ‘ঘরবাড়ি হারিয়ে থাকার ভাড়া জমিও পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকু বাড়ি করার উপযোগী নয়। তার পরও দাম বেশি। প্রতি বিঘা জমি ৩-৪ লাখ টাকা ১০ বছর মেয়াদি ভাড়া। আর শতক ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। নদ-নদীর ভাঙনে বেকারের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোনো শিল্প-কারখানা না থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়।’
নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের ব্যাপারীর চর গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধ সিফাত উল্লাহ বলেন, ‘বাপ-দাদারা এই চরে বসতি স্থাপন করেন। শত বছরের ওপরে এখানে তারা আছেন। হঠাৎ করে গত বছর চরটি দুধকুমার নদীর ভাঙনের মুখে পড়ে। গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করে। এই নদীর ভাঙনে ১৫টি পরিবার সব কিছুই হারিয়েছে।’
গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউপি সদস্য বাবলু মণ্ডল বলেন, ‘তিস্তা নদীর ভাঙনে ৭-৮ মাস আগে আড়াই শ বাড়ি ভেঙে গেছে।’
চর নেওয়াজি বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়টি নদীভাঙনে হুমকির মুখে। আমি ওপর মহলে কথা বলেও কোনো সাড়া পাচ্ছি না। এখন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না, কী করব।’
এ বিষয়ে মোহনগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শাহ আলম জানান, ঢাকাইয়া পাড়ায় যে বাড়িগুলো ভেঙে গেছে, তারা কয়েক দফায় ভাঙনের শিকার হয়ে এলাকায় বসতি গড়ে। কিন্তু সেটিও এখন ভেঙে গেল। বর্তমানে এদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’
কুড়িগ্রামে ৯টি উপজেলায় ৩টি পৌরসভা ও ৭৩টি ইউনিয়ন। এর মধ্যে ৫৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা ভাঙনের শিকার। শতভাগ ভাঙনকবলিত দুটি উপজেলা চিলমারী ও রাজিবপুর। জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন আটটি ইউনিয়ন। সাড়ে পাঁচ শতাধিক চরাঞ্চলে ৭ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পৌরসভা, কাঁঠালবাড়ী, হলোখানা, পাঁচগাছি, যাত্রাপুর, মোগলবাসা, ঘোগাদহ ও ভোগডাঙ্গা।
নাগেশ্বরী উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে রায়গঞ্জ, বামনডাঙ্গা, কেদার, কালীগঞ্জ, বল্লভেরখাস, কচাকাটা, নারায়ণপুর, বেরুবাড়ি, নুনখাওয়া ইউনিয়ন দুধকুমার, গংগাধর এবং ব্রহ্মপুত্র নদে ভাঙনের শিকার।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে দুধকুমার নদের ভাঙনে শিলখুড়ি, তিলাই, বলদিয়া, চরভূরুঙ্গামারী, পাইকারছড়া, বঙ্গসোনাহাট, আন্ধারীঝাড় ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে ধরলা, তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কবলে পড়েছে হাতিয়া, বুড়াবুড়ি, তবকপুর, বজরা, থেতরাই, গুনাইগাছ, বেগমগঞ্জ ওসাহেবের আলগা।
ফুলবাড়ীর ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে ধরলা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে নাওডাঙ্গা, শিমুলবাড়ী, ফুলবাড়ী সদর, বড়ভিটা, ভাঙ্গা মোড়।
রৌমারী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ ও জিঞ্জিরাম নদের ভাঙনের মুখে বিলিন হচ্ছে বন্দবের, রৌমারী সদর, যাদুরচর, চর শৌলমারী ইউনিয়ন।
রাজিবপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন কোদালকাটি, মোহনগঞ্জ, রাজিবপুর সদর ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত।
চিলমারী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের অষ্টমির চর, নয়ারহাট, চিলমারী সদর, থানাহাট, রমনা এবং রাণীগঞ্জ ইউনিয়ন ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজারহাট উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে তিস্তা ও ধরলা নদীর ভাঙনের শিকার ঘড়িয়ালডাঙ্গা, ছিনাই, বিদ্যানন্দ ও নাজিম খাঁ ইউনিয়ন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কুড়িগ্রামে প্রায় ২০ কিলোমিটার ভাঙনকবলিত হয়েছিল। এর মধ্যে আমরা প্রায় ৮ কিলোমিটার নদীর ভাঙন রোধে কাজ করতে পেরেছি। এ ছাড়া ধরলা এবং দুধকুমার নদীতে ড্রেজিং করার জন্য একটি সমীক্ষা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’