গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে একটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাধা দেয়ার পর ভুঁড়ি ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় একজন পোলিং কর্মকর্তাকে। এরপর তিনি ভয়ে আর কিছু বলেননি। আর কেন্দ্র ছেড়ে বাইরে চলে আসেন।
কেন্দ্রের বাইরে সেই পোলিং অফিসার বীথি বেগমের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তিনি জানান, তার কেন্দ্রে শুরুতে আওয়ামী লীগের নৌকার মার্কার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কার এজেন্টও ছিলেন। কিন্তু পরে লাঙ্গলের এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়।
এরপর কোনো ভোটার এলে আঙ্গুলের ছাপে তার পরিচয় নিশ্চিত করার পর তার ভোট গোপন কক্ষে গিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
বীথি বলেন, ‘ভোট শুরুর আগে দুইজন নৌকার এজেন্ট আসল। তার পর লাঙলের এজেন্টও আসল। এর পর কয়েকজন এসে লাঙলের এজেন্টের পরিচয়পত্র কেড়ে নিয়ে তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। এরপর কয়েকজন ভোটারের আঙুলের ছাপ দেয়ার পর তাদের ভোট জোর করে নৌকায় মারেন তারা।’
আপনি কিছু বলেননি কেন- এমন প্রশ্নে এই পোলিং অফিসার বলেন, “আমি তাদের কক্ষ থেকে বের হতে বললে তারা আমাকেও হুমকি দিয়ে বলে, ‘চুপচাপ বসে থাকেন; নইলে খবর আছে। আর একটাও কথা বললে, ভুঁড়ি ফেলে দেব।’ এ কথা শোনার পর আমি ভয়ে কক্ষ থেকে বাহিরে চলে আসি।”
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পর একাধিক নির্বাচন কমিশনার গোপন কক্ষে অবস্থান নেয়া এই ব্যক্তিদের ডাকাত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, গোপন কক্ষের ডাকাত প্রতিরোধই তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
প্রায় সব কেন্দ্রেই দিনভর ভোটারের উপস্থিতি ছিল বেশ কম
কমিশন ব্যালটের চেয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট নিতে আগ্রহী এ কারণে যে, এখানে আঙ্গুলের ছাপে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে। কারও পক্ষে জাল ভোট বা অন্যের ভোট দিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
তবে ইভিএমে ভোটারের পরিচয় শনাক্তের পর গোপন কক্ষে থাকা ব্যক্তি নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠতে থাকে শুরু থেকেই। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর ভোট কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে ভোট পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে, যেন ভেতরে অননুমোদিত কেউ থাকতে না পারে।
গাইবান্ধা-৫ আসনে ১৪৫টি কেন্দ্রের সবগুলোতেই স্থাপন করা হয় এক হাজারের বেশি ক্যামেরা। আর ঢাকা থেকে ভোট পর্যবেক্ষণও করা হয়। এই পর্যবেক্ষণেই দেখা যায়, ‘গোপন কক্ষের ডাকাতরা’ ভোটারের ভোট দিয়ে দিচ্ছেন।
এই অনিয়ম দেখে একের পর এক কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করতে থাকে নির্বাচন কমিশন। দুপুরের আগেই সংখ্যাটি গিয়ে ঠেকে ৫১তে। পরে আড়াইটার সময় সব কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে দেয়ার কথা জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সকাল থেকে নিউজবাংলা বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে ভোটারদের মধ্যে ভয়ের ছাপ দেখতে পেয়েছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছিল অননুমোদিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি।
বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনের এই জটলা মূলত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের, যারা ভোটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠে
প্রায় সব কেন্দ্রেই ভোটারের উপস্থিতি ছিল একেবারে কম। দুপুর পর্যন্ত কয়েকজন করে ভোট দিতে আসেন।
তবে প্রায় কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল লক্ষ্যণীয়। নৌকা মার্কার টিশাট পরে তারা কেন্দ্রের ভেতরেও অবাধ চলাচলও করেন।
কেন্দ্রের বাইরের রাস্তাতেও অবস্থা নেয় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। তারা জাতীয় পার্টির কর্মীদের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাঘাটার একটি কেন্দ্রে আদিপত্য বিস্তার করায় ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়। এর পরেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে প্রায় সব কেন্দ্রেই।
প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে ও ভেতরে র্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটে। তবে কেউ ব্যবস্থা নেননি।
কঞ্চিপাড়া এম ইউ একাডেমি কেন্দ্রের ইনচার্জ এএসআই অজয় রায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে বলেন, 'এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি, কোনো জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেনি। কঠোর নিরাপত্তা জোরদার ছিল।'
তবে অনিয়মের অভিযোগে যেসব কেন্দ্রগুলোর ভোট প্রথমেই স্থগিত করা হয়, তার মধ্যে ছিল এই কেন্দ্রটি।
কেন্দ্র ও আশেপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ আছে
এই পুলিশ কর্মকর্তার মতোই ভোট বন্ধ করে দেয়া হয় এমন কেন্দ্রগুলোর অনিয়মের বিষয়ে স্বীকার করতে চান না নির্বাচন কর্মকর্তারা।
কঞ্চিপাড়া এম ইউ একাডেমি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার কাজল মিয়া বলেন, 'সকাল ৮টা থেকে ভোটাররা কেন্দ্রে ভোট দিচ্ছিলেন। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই দুপুর পর্যন্ত ভোট নেয়া হয় সুষ্ঠুভাবে। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ ভোট নেয়া বন্ধ করতে নির্দেশ পাই।'
এই কেন্দ্রটিতে আওয়ামী লীগের লোকজন ও বহিরাগতরা আতিপত্য বিস্তার ও আঙুলের ছাপ নিয়ে ভোটারকে বের করে দিয়ে নৌকায় ভোট দেন বলে অভিযোগ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম শহীদ রনজু।
দলদলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে সামান্য ঝামেলা হয়েছিল। কয়েকজন লোক বুথে ঢুকে ভোট দেয়ার চেষ্টা করে। আমরা দ্রুত তা সমাধান করি। তার পর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোট বন্ধ করতে বলেন।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ অভিযোগ করে বলেন, 'একটি কেন্দ্রেও আমার এজেন্টে ঢুকতে দেয়নি। আপেল মার্কার ভোটারের আঙুলের ছাপ নেয়ার পর ভোট মারা হয় নৌকায়। এসব অভিযোগে আমি ভোট বর্জন করেছি।'
ভোটে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ কেন পালন করা যায়নি, সে বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী রিটানিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে চাননি। আর রির্টানিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সরাসরি বক্তব্য নিতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তার কাছে যেতে বলেন।
তার দেয়া সময় অনুযায়ী জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। সে সময় জানানো হয়, তিনি সাঘাটা উপজেলায় গেছেন। আসলে পরে বক্তব্য দেবেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময় তিনি কার্যালয়ে ফেরেননি।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন দাবি করেছেন, ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি। নির্বাচন কমিশন ভোট বাতিল করে দেয়ার পর নির্বাচনি এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের বিক্ষোভের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, ‘কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। অবাধ এবং শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। সব অভিযোগ মিথ্যা বরং বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নৌকার এজেন্টদের তাড়িয়ে দেয়া হয়।’
কেন তাহলে ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন এমন প্রশ্নে রিপন বলেন, ‘ভোট বন্ধের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার রয়েছে। তবে কেন বা কী অভিযোগে এমনটা হলো, তা আমার জানা নেই।’