ভোটারের গোপন কক্ষে ‘ডাকাত’ রেখে তাদের ভোট নিয়ে নেয়ার অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বাতিল করে দেয়ার পর যার দিকে অভিযোগের তীর, সেই নৌকার প্রার্থী মাহমুদুল হাসান রিপন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তার দাবি, নির্বাচনে কোনো ঝামেলা হয়নি। অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে সব অসত্য।
বুধবার উত্তরের জেলায় শীতের আগে আগে এই উপনির্বাচনের ভোট রাজনীতিতে নতুন ঝড় তুলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এতে আবার একটি উদাহরণও তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর সত্যি সত্যি কঠোর পদক্ষেপ নেয়।
কমিশন আগে থেকেই বলে আসছিল, কোনো কেন্দ্রে ভোটে গোলযোগ হলে ভোট বন্ধ হয়ে যাবে। একে একে ৫১টি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল যখন ভোট বাতিলের ঘোষণা দেন, তখন তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একটি পক্ষ বা একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোট প্রভাবিত করতে পারছেন। আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে- সুষ্ঠু নির্বাচন গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা ৫১টি ভোটকেন্দ্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আইন কানুন পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিলাম।’
সকাল থেকেই ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসতে থাকে। আঙ্গুলের ছাপে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কোথাও তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়, কোথাও তাকে সহযোগিতার নামে গোপন কক্ষে অবস্থান করে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে দেয়ার অভিযোগ আসতে থাকে।
নির্বাচন কমিশন একাধিকবার এই ব্যক্তিদের ‘ডাকাত’ উল্লেখ করে বলেছে, ডাকাত ঠেকানোই তাদের চ্যালেঞ্জ।
সিসিটিভি ফুটেজে গোপন কক্ষে অনিয়ম দেখতে পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। ছবি: ইসি
স্পষ্টতই অভিযোগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু ভোট চলাকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে এজেন্ট জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে। … ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার পর তাকে বের করে দেয়া হয়েছে।
‘এমনও দেখেছি, একটি ভিডিও ফুটেজ আছে যে, আঙ্গুলের ছাপটা তাদের নিজেদের লোকরাই বসায়ে বসায়ে দিচ্ছে যে, এখানে দেন এখানে দেন এখানে দেন। এটা হচ্ছে এক শরও অধিক কেন্দ্রের বাস্তবতা। সুতরাং এটা প্রহসনের ভোট, এটাকে ভোটই বলা যায় না।’
তবে নৌকার প্রার্থী রিপনের দাবি এসব কিছুই ঘটেনি। তিনি বলেন, ‘কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। অবাধ এবং শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। সব অভিযোগ মিথ্যা বরং বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নৌকার এজেন্টদের তাড়িয়ে দেয়া হয়।'
কেন তাহলে ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন এমন প্রশ্নে রিপন বলেন, 'ভোট বন্ধের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার রয়েছে। তবে কেন বা কী অভিযোগে এমনটা হলো, তা আমার জানা নেই।'
বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে রিপন বলেন, ‘কোনো বাস্তবসম্মত যৌক্তিক ছাড়াই নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করে, যা সাধারণ ভোটারদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তার পরেও আমরা কমিশনের একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নেই।
‘দুপুর আড়াই দিকে নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করেই ভোট বন্ধ করে দেয়, যা ভোটারসহ এলাকাবাসীকে হতবাক ও মর্মাহত করেছে। তবে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা বিক্ষুব্ধদের শান্ত করেছি।’
সব কেন্দ্রে ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে নৌকার প্রার্থী বলেন, ‘যেসব কেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে; সেসব কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হোক। বাকি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট হোক।’
নৌকার প্রার্থীর দাবি, তফসিল হওয়ার পর থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সব প্রার্থী প্রচার চালিয়েছেন। সকাল থেকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ভোট কেন্দ্রে আসতে থাকে ভোটাররা। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সংঘাতও ঘটেনি। তাছাড়া কেউ আটকও হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির উপর দোষ চাপিয়ে রিপন বলেন, ‘আমি বা আমার নেতাকর্মীরা এমন কোনো কাজ করেনি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। পুরো বিষয়টিই আমার কাছে রহস্যময়। এটা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। তারা আমার নাম ছবি ব্যবহার করে টিশার্ট বানিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজন ভোটকেন্দ্রে নৈরাজ্য করেছে। পরিকল্পিতভাবে ভোটকে বাধাগ্রস্ত করতেই তারা এ কাজ করেছে বলে আমি মনে করি।
‘আমার কাছে পুরো বিষয়টিই রহস্যময়। আমি এর কোনো কুলকিনারা পাচ্ছি না। তবে এটা স্পষ্ট করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’
ভোট চলাকালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছাড়াও কূলা প্রতীকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম, আপেল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও ট্রাক প্রতীকে আরেক নির্দলীয় প্রার্থী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। তারা সবাই নির্বাচন বাতিল করে নতুন করে ভোট নেয়ার দাবি জানান। তবে এই ঘটনাটি বাংলাদেশে বিরল, যেটি সত্যি করে দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের সিদ্ধান্তে দারুণ খুশি লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী গোলাম শহীদ রনজু। তিনি এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ভোটে আজ কী হয়েছে সেটা দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
নতুন করে ভোট হলে তাতে অংশ নেবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুনরায় ভোটে আমরা যাব কি না; তা এখনিই সিদ্ধান্ত নয়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীভাবে সিদ্ধান্ত আসবে।’