রাজধানীর উত্তরায় কিংফিশার রেস্টুরেন্ট ও লেকভিউ বারে বৃহস্পতিবার অভিযান চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। জব্দ করা হয় ৫০০ বোতল বিদেশি মদ ও প্রায় ছয় হাজার ক্যান বিয়ার। গ্রেপ্তার করা হয় ৩৫ জনকে।
অভিযানের পর ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই রেস্টুরেন্ট ও বারে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করে ডিবি পুলিশ, যার ১ নম্বর আসামি বার মালিক মোক্তার হোসেন। কে এই মোক্তার হোসেন তা জানতে অনুসন্ধানে নামে নিউজবাংলা। আর তাতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
জানা যায়, নেহায়েত দরিদ্র পরিবারের সন্তান গাজী মোক্তার হোসেন চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন। একটি কোরিয়ান ক্লাবে চাকরির সুবাদে পরিচিত হন বার ব্যবসার সঙ্গে। একই সঙ্গে জড়িত হন গ্রামের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে। আর সে সুবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। হয়ে ওঠেন স্থানীয় বালু ব্যবসার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য।
রেস্টুরেন্ট ও বারে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে এমন অভিযোগে উত্তরায় কিংফিশার রেস্টুরেন্ট ও লেকভিউ বারে চালানো অভিযানের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় করা ডিবির মামলায় ১ নম্বর আসামি বার মালিক মোক্তার হোসেন। ছবি: নিউজবাংলা
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ঢাকায় মোক্তারের জন্য বড় ‘আশীর্বাদ’ হয়ে আসে সাবেক এক আমলার ছত্রছায়া। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক এই আমলার ছত্রছায়ায় এসে মোক্তার রাজধানীতে একে একে পাঁচটি বারের মালিক বনে যান। দেশের বার জগতে তিনি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।
মোক্তারের উত্থান
মোক্তারের বারে অভিযান চালানোর পর ডিবির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। তবে এই অভিযানকে যৌক্তিক ও বৈধ দাবি করা হয় ডিবির পক্ষ থেকে।
মোক্তারের বারে অনুমোদনবিহীন মদ ও অসামাজিক কাজ চলার অভিযোগ করেন ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তাৎপর্যের বিষয় হলো, মোক্তারের বিষয়ে এখন আর আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি নন ডিবির কোনো কর্মকর্তা। মোক্তারের উত্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির একাধিক কর্মকর্তা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে নাম প্রাকাশ না করার শর্তে ডিবির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, মুক্তার চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোক্তার প্রথমে ঢাকায় এসে একটি কোরিয়ান বারে চাকরি পান। এই চাকরির সুবাদে অবৈধভাবে মদ বেচাকেনার সঙ্গে জড়ান।
অবৈধভাবে মদের কারবার করে কিছু অর্থকড়ি কামিয়ে নেন মোক্তার। একপর্যায়ে স্থানীয় রাজনৈতিক যোগাযোগের সূত্র ধরে সাবেক এক মন্ত্রীর মাধ্যমে তার পরিচয় হয় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে। এরপর বিভিন্নজনকে ব্যবহার করে একে একে বাগিয়ে নেন বার পরিচালনার পাঁচটি লাইসেন্স। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ক্ষমতার বলয় বাড়ানোর জন্যে ইউনিয়ন পর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন মোক্তার হোসেন। ছবি: নিউজবাংলা
বিদেশে মোক্তারের সম্পদ রয়েছে কি না জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কোনো তথ্য পাইনি। তবে তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকেন।‘
ডিবির দায়ের করা মামলায় মোক্তারকে ১ নম্বর আসামি করা হলেও তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘তদন্ত চলছে। একই সঙ্গে তাকে মনিটরিংয়ে রাখা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রয়োজন মনে করলে তাকে গ্রেপ্তার করবে।’
মোক্তারের বিষয়ে খোঁজ জানতে তার গ্রামের বাড়িতেও অনুসন্ধান চালায় নিউজবাংলা। জানা যায়, তার পুরো নাম গাজী মোক্তার হোসেন। চাঁদপুরের মতলব উপজেলার জহিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়।
মোক্তারকে বাল্যকাল থেকে চেনেন এমন স্থানীয় দুজনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, মতলব উপজেলার ফরাজীকান্দি ইউনিয়নের নিশানখোলা গ্রামে ছিল মোক্তারের বাবার ভিটা। তার জন্মও সেখানেই। অভাবতাড়িত পরিবারটি পরবর্তী সময়ে একই উপজেলার জহিরাবাদ ইউনিয়নে চলে আসে। এখনও সেখানেই বাস করছে পরিবারটি। সেখানে তাদের একটি টিনের বাড়ি আছে।
মোক্তারের বাবা পেশায় একজন অটোরিকশাচালক ছিলেন। মোক্তার শুরু থেকেই স্থানীয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে চাকরির খোঁজে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। এর বেশ কয়েক বছর পর গ্রামের সবাই জানতে পারেন ঢাকায় মোক্তারের একাধিক হোটেল ও বার আছে।
টাকার মালিক হওয়ার পর ১০ বছর ধরে মোক্তার আবার স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। তিনি বর্তমানে জহিরাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।
সবশেষ চাঁদপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে ২ নম্বর ওয়ার্ডে সদস্য পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি চাঁদপুরের কুখ্যাত বালু ব্যবসায়ী সেলিম খানের সিন্ডিকেটের সদস্য বনে যান এই মোক্তার।
তার পূর্বপরিচিত ওই দুই ব্যক্তি আরও জানান, মোক্তার স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একজন এমপি ও সাবেক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তার মাধ্যমেই বিভিন্ন রাজনীতিক ও প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে মোক্তারের পরিচয় এবং সম্পর্ক তৈরি হয়। মোক্তারের ছোট দুই ভাইয়ের একজন গাজী সেলিম জহিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আরেক ভাই গাজী সম্রাট চাঁদপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য।
ঢাকায় মোক্তারের খুঁটির জোর সাবেক আমলা
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোক্তার প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯৯৭ সালে। কোরিয়ান একটি বারে চাকরি করেন বেশ কিছুদিন। এ সময় তার মদের কারবার সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হয়। অবৈধ মদ বিক্রি করে রাতারাতি কিছু টাকার মালিক বনে যান।
পরবর্তী সময়ে নিজে আবাসিক হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে মোক্তারের ঘনিষ্ঠতা হয়। ওই অতিরিক্ত সচিবকে ধরেই হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি প্রথম বারের লাইসেন্স পান।
এরপর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভালো যোগাযোগ তৈরি হয় তার। একে একে আরও চারটি বারের লাইসেন্স পান মোক্তার। এরপর রাজনৈতিক প্রভাবে দেশের বার জগতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
নিজের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বৈধ কাগজ থাকলেও আড়ালে অনুমোদনহীন মদও বিক্রি করতেন নিয়মিত। এমনকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এমনকি মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোক্তারের বারগুলোর সব কাগজপত্র ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। সে একজন মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে প্রভাব খাটিয়ে চলত। আমাদের সঙ্গেও এক ধরনের ড্যাম কেয়ার ভাব দেখাত।
‘মোক্তার অনেকবার বেয়াদবিও করেছে আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কাগজ ঠিক থাকায় আর তার রাজনৈতিক প্রভাবের কথা ভেবে হয়তো কর্মকর্তারা তাকে কড়া জবাব দেননি। তবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও বার ব্যবসায়ীদের অনেকেই তাকে পছন্দ করে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজনৈতিক যোগাযোগ আর সাবেক ওই আমলার ছত্রছায়ায় আবাসিক হোটেল ব্যবসাসহ লেকভিউ রিক্রিয়েশন ক্লাব, উত্তরার লেকভিউ বার, গুলশানের কিংফিশার বার, নারায়ণগঞ্জে ব্লুফিয়ার নামে আরো একটি বারসহ উত্তরার কিংফিশার রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছেন মোক্তার।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় গাজী মোক্তার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৯৭ সালে ঢাকায় এসে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আবাসিক হোটেলে ম্যানেজার পদে চাকরি নেন। এরপর পরিবার থেকে ২ লাখ টাকা নিয়ে আবাসিক হোটেল ব্যবসা শুরু করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কোরিয়া-বাংলাদেশ ক্লাবে যুক্ত হয়ে বারের ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নিজেই বারের অনুমোদন নেন। পরে শুরু করেন বার ব্যবসা। পরবর্তী সময়ে আরো চারটি বারের মালিক হন। এর মধ্যে হেফাজত নেতাদের বাধায় নারায়ণগঞ্জের বারটি আর চালু করা সম্ভব হয়নি।
কোনো অবৈধ উপায়ে তার ব্যবসায় বিনিয়োগ হয়নি দাবি করে মোক্তার জানান, তার পরিবার সচ্ছল ছিল। বাবা অটোরিকশাচালক ছিলেন- এ তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই। ব্যবসা শুরু করতে তার বাবাই তাকে টাকা দিয়েছিলেন।
লাইসেন্স নিয়ে বৈধভাবে এতদিন ব্যবসা করে আসছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার সম্মান ক্ষুণ্ন করতে এসব কথা ছড়ানো হচ্ছে। আমি যদি অবৈধ মদের ব্যবসা করে থাকি তাহলে ডিবি সদস্যরা প্রমাণ করুক।
‘অনেক পত্রিকায় দেখলাম লিখেছে যে আমি পলাতক। অথচ আমি আজও আমার মায়ের মৃত্যুর তিন দিনের মিলাদ শেষ করলাম। আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। মোবাইল ফোন সেটও খোলা রেখেছি। তারা যদি আমাকে ডাকে আমি নিজে গিয়ে হাজির হব৷’
বিদেশে সম্পদ আছে কি না এবং স্ত্রী-সন্তানরা কোথায় থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। আমার স্ত্রী-সন্তানরা সেখানেই আছে। আমার বিদেশে সম্পদ থাকলে আপনারা বের করে দেখান।’
একাধিক আমলা ও সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য এবং চাঁদপুরের কুখ্যাত বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ার অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেন এই বার ব্যবসায়ী।