‘ভালো মানুষই তো ট্রলারে উঠতে ভয় পায়। আমি তো অন্ধ, তারপর আবার বৃদ্ধ। এত কষ্ট নিয়া যাতায়াত করতে হয়। এখন তো আর কষ্ট নাই। লাঠি নিয়ে হেঁটেই সেতু পার হতে পারবো। অনেক বছর ধরে তো এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম।’
নারাণগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এ কথাগুলো বলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হারুন মিয়া। সেতুটির উদ্বোধনের পর সোমবার ঢল নামে মানুষের। কেউ ইজিবাইক দিয়ে, কেউ হেঁটে সেতু পারি দিচ্ছিলেন দিনভর।
হারুনও সেতুতে ঘুরতে এসেছেন। রেলিং ধরে হেঁটে উপভোগ করছিলেন অন্যদের মতোই। নদী পারি দিতে কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে করে হঠাৎ কেঁদে ওঠেন।
তিনি বলেন, ‘এটা শুধু সেতু না, স্বপ্ন। অনেক অপেক্ষার পর পেয়েছি।’
ঢাকা থেকে সোমবার দুপুর ১২টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই সেতুর দুই পাড়ে মানুষের ঢল নামে।
বন্দরের বাসিন্দা শিপুল মিয়া বলেন, ‘আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, সেতু চালু হলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখব। অনেক বছর ধরে সেতুর কাজ হয়েছে। অপেক্ষায় ছিলাম কবে চালু হবে।
‘কাল থেকে সেতু পার হয়ে কাজে যাব। কত ভালো লাগছে কীভাবে যে বোঝাবো!’
হারুন ও শিপলুর মতো নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দরের মানুষের কাছে এই সেতু ভোগান্তির কমানোর পথ তৈরি করে দিয়েছে। শহর থেকে বন্দরে যেতে এখন আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর হয়ে যেতে হবে না। বরং এই সেতু হয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট মহাসড়কের পথ কমেছে অন্তত ১০ কিলোমিটার।
বন্দরের ফরাজীকান্দা এলাকার রোজিনা বেগম বলেন, ‘এখন নদী পার হওয়ার কষ্ট কমলো। রোগী নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যেতে হলে আগে পথে পথে ভোগান্তিতে পড়তে হতো। এই কষ্টের দিন শেষ।
‘এখন আমাদের আনন্দের সময়। বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে শহরে যেতে পারব।’
বন্দর উপজেলার নির্বার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) কুদরতে খোদা জানান, উচ্ছ্বসিত লোকজন সেতুতে হাঁটাহাঁটি করছেন। তারা উপভোগ করছেন দিনটি। তাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদস্যরা আছেন। রাত ১২টার পর বড় যানবাহন চলতে শুরু করবে সেতু দিয়ে।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দিপক চন্দ্র সাহা বলেন, ‘সেতুর বন্দরের অংশে পুলিশের টহল থাকবে, আর নারায়ণগঞ্জের অংশে সদর থানার। মূলত রাতে সেতুতে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে সেতুর দুপাশে সর্তক থাকার ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ায় নৌকা ও ট্রলারে ভোগান্তি নিয়ে নদী পারাপার হওয়া অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের কষ্টের অবসান ঘটেছে। নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে দুটি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার।
‘এখন এখানে বিভিন্ন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। আরও উন্নয়ন হবে এ অঞ্চলের মানুষের।’
নতুন এই সেতুতে ট্রেলার ৬২৫ টাকা, হেভি ট্রাক ৫০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ২৫০ টাকা, মিনি ট্রাক ১৯০ টাকা, বড় বাস ২২৫ টাকা, মিনিবাস ১২৫ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা, প্রাইভেটকার ১০০ টাকা, তিন চাকার মোটরযান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১৫ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান, সাইকেল ও ঠেলাগাড়িকে পাঁচ টাকা করে টোল দিতে হবে।
এই সেতুর উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে নারায়ণগঞ্জ সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের সংগঠনের দিক থেকেও নারায়ণগঞ্জ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে আমরা চিন্তা করেছি নারায়ণগঞ্জবাসীর যোগাযোগ সহজ করা এবং তাদের জীবনযাত্রা উন্নত করা, এটা একান্তভাবে দরকার। সেদিকটা মাথায় রেখেই আমি শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর তৃতীয় সেতু নির্মাণ করলাম। ইতোমধ্যেই শীতলক্ষ্যার ওপর আরও কয়েকটি সেতু করেছি। শীতলক্ষ্যা-১ ও ২ আমার হাতে হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আজকে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ-ঢাকা শহরের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যার ফলে এখন ঢাকা শহর দিয়ে যেতে হবে না। পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সরাসরি এই সেতু পার হয়ে চলে যেতে পারবে। তাহলে ঢাকার ভেতর যানজটাও কম হবে।’
২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বন্দরের মদনগঞ্জ ও সদরের সৈয়দপুর এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর নামকরণ করা হয় বীরমুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু।
১২৩৪ দশমিক ৫০মিটার লম্বা এই সেতুর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬০৮ কোটি টাকা।