রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিশ্ববাসীকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘যুদ্ধের আড়ালে অস্ত্র কেনাবেচার প্রতিযোগিতায় যে অর্থ ব্যয় হয়, তা শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও তাদের সুন্দর আগামী বিনির্মাণে ব্যয় করা উচিত।
নড়াইলের মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত ‘মধুমতী সেতু’ এবং নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ঢাকার তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে সোমবার দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
‘মধুমতী সেতু’ এবং ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে সোমবার দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারি ও তার ধাক্কা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যা আমাদের উন্নয়নের গতিকে অনেকটা শ্লথ করে দিয়েছে। শুধু আমরা না, বিশ্বব্যাপী মানুষ কষ্ট ভোগ করছে। এ জন্য সব সময় আমার আবেদন থাকবে, আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই। মানুষের উন্নতি চাই।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুদ্ধ ঘিরে নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই যুদ্ধে অস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে যেসব অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যে অর্থ ব্যয় হয়, সেই অর্থ সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য ব্যয় করা হোক। তাদের শিক্ষা, তাদের চিকিৎসা, তাদের ভালো জীবনের জন্য ব্যয় করা হোক। বিশ্ববাসীর কাছে সেটাই আহ্বান জানাই।’
এই সংকট কাটিয়ে দেশের উন্নয়নকে আবার এগিয়ে নিয়ে যেতে চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নে আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রাখব এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য আমরা সবাই নিরলস পরিশ্রম করে যাব। এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
‘বাংলাদেশটাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সমগ্র বাংলাদেশ আমি সফর করেছি। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সব থেকে বেশি প্রয়োজন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি করা। কাজেই আমাদের সাধ্যমতো আমরা সেটা করেছি।’
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার প্রসঙ্গটিও ওঠে আসে বক্তব্যে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছয় বছর পর আমি দেশে আসার সুযোগ পাই। তারপর থেকে আমার প্রচেষ্টা বাংলাদেশটাকে গড়ে তোলা। যখনই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছি, তখন থেকেই জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছি।
‘আওয়ামী লীগের ইতিহাস হলো আওয়ামী লীগ সব সময় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে জনগণের সমর্থন নিয়ে। এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখেছে।’
‘উন্নয়ন এগিয়ে নেবে দুই সেতু’
সেতু দুটি নির্মাণ দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটা সুযোগ তৈরি হলো।’
নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সদর উপজেলায় যুক্ত করতে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত তৃতীয় সেতুর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে নারায়ণগঞ্জ সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের সংগঠনের দিক থেকেও নারায়ণগঞ্জ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে আমরা চিন্তা করেছি নারায়ণগঞ্জবাসীর যোগাযোগ সহজ করা এবং তাদের জীবনযাত্রা উন্নত করা, এটা একান্তভাবে দরকার। সেদিকটা মাথায় রেখেই আমি শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর তৃতীয় সেতু নির্মাণ করলাম। ইতোমধ্যেই শীতলক্ষ্যার ওপর আরও কয়েকটি সেতু করেছি। শীতলক্ষ্যা-১ ও ২ আমার হাতে হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আজকে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ-ঢাকা শহরের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যার ফলে এখন ঢাকা শহর দিয়ে যেতে হবে না। পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সরাসরি এই সেতু পার হয়ে চলে যেতে পারবে। তাহলে ঢাকার ভেতর যানজটাও কম হবে।’
মধুমতী সেতু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মধুমতী সেতু দিয়ে আমরা ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হয়ে যাব। যার ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে এবং ঢাকা থেকে মোংলা পোর্টই সবচেয়ে কাছে হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আমাদের বেনাপোল, মোংলাসহ কুষ্টিয়া অঞ্চলের যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে, মানুষের সময় আরও বাঁচবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল হবে, সেই সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে।
‘আমরা মনে করি, এই যোগাযোগের ফলে আমাদের ওই সব অবহেলিত অঞ্চলগুলো আরো বেশি উন্নতি লাভ করবে।’
মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় সেটির নাম কালনা করা হলেও পরে নদীর নামেই তা করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমি চিন্তা করলাম, এটি যেহেতু মধুমতী নদীর ওপরে মধুমতী নামটাও খুব মিষ্টি নাম। কাজেই এই নামেই সেতুটা হোক। তাই আমি মধুমতী সেতু নামটা দিয়েছি।’
সেতু নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতার জন্য বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র জাপান ও সৌদি আরবের প্রতি ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে আরও যাতে বিনিয়োগ আসে আমরা সে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইনভেস্টমেন্ট করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। জাপান আমাদের অনেক কাজ করে দিচ্ছে।’
দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু
৬৯০ মিটার দীর্ঘ মধুমতী সেতুতে রয়েছে ৬টি লেন। আর এটি নির্মাণে প্রয়োজন হয়েছে ১৩টি স্প্যান। দুই প্রান্ত মিলিয়ে সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে ৪ দশমিক ২৭ কিলোমিটার। এই সেতুর মধ্য দিয়ে ঢাকা-পদ্মা সেতু-ভাঙা-যশোর-বেনাপোল সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হলো। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে দেশের বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
এই সেতু চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলা বন্দরের মধ্যেও সরাসরি সংযোগ তৈরি করেছে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও শহরকে যুক্ত করতে শীতলক্ষ্যায় খুলে দেয়া হলো তৃতীয় সেতুটি। ৬০৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটিও ছয় লেনের। যেখানে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ ২৬৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আর সৌদি উন্নয়ন তহবিলের বিনিয়োগ ৩৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এই সেতুর কারণে পদ্মা সেতু হয়ে মুন্সীগঞ্জের মোক্তারপুর সেতু হয়ে ঢাকা মহানগরে না এসে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সংযোগ তৈরি হলো।