২০১৯ সাল থেকে পরবর্তী আড়াই বছরে একে একে তিন স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে নওগাঁর আকরাম হোসেনের। প্রথম স্ত্রী লাভলীর মৃত্যু হয় রাতের বেলা স্ট্রোকে। তখন বাসায় আকরাম ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। দ্বিতীয় স্ত্রীরও মৃত্যু হয় স্ট্রোকে।
গত জানুয়ারিতে তৃতীয় স্ত্রী সাথীর মৃত্যু হয় রাতের বেলা মহাসড়কে অজ্ঞাত আততায়ীর হামলায়।
কিন্তু এবার ফেঁসে যান ৫১ বছর বয়সী আকরাম। এই মৃত্যু সাজানো বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের মনে হয়েছে। আকরামকে আটক করেছে পুলিশ। আর এরই সূত্র ধরে উঠে এসেছে আগের দুই স্ত্রীর মৃত্যুর প্রসঙ্গ। খোঁজখবরে দেখা যাচ্ছে, আগের মৃত্যুগুলোও সন্দেহ তৈরি করেছিল। কিন্তু আকরাম সেগুলো ধামাচাপা দেন।
তৃতীয় স্ত্রী সাথীর বাবা শহিদুল হক মামলা করেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে আকরামই মেরে ফেলেছে। পরে মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে। সে মানুষরূপী পশু।’
তৃতীয় স্ত্রী সাথী বানুর মৃত্যুরহস্য
তৃতীয় স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে আকরাম হোসেন পুলিশকে যে ভাষ্য দিয়েছেন, তাতে তিনি দাবি করেছেন, গত ১৬ জানুয়ারি এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে বাইক নিয়ে বাড়িতে ফেরার পথে দুবলহাটি এলাকার যুমনী নামক স্থানে পেছন থেকে পাঁচ-ছয় জন তাদের ওপর হামলা চালায়। বাইক চলন্ত অবস্থায় ছিল। মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দিলে দুজনই রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে যান।
এ সময় আকরামের চিৎকারে স্থানীয়রা ছুটে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সাথীর। পরে আহত আকরামকে উদ্ধার করে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার পরদিন নিহত সাথীর বাবা অজ্ঞাত পাঁচ-ছয় জনকে আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলার পরদিন পুলিশ তদন্তে মাঠে নামে।
ঘটনাস্থল যুমনী নামক স্থানে দুর্বৃত্তরা হামলা করেছিল বলে আকরাম পুলিশকে জানান। কিন্তু অন্ধকার পথে কারা তাদের পড়ে থাকতে দেখেছে? পুলিশ কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা উদ্ধারকারীই খুঁজে পাচ্ছিল না। পাঁচ দিন পর একজনের খোঁজ পাওয়া যায়, যিনি আকরামকে উদ্ধার করেছিলেন। তিনি স্থানীয় এন্টিতলা এলাকার জননী গ্রামের সোহেল হোসেন। সোহেল একজন অটোরিকশাচালক। সোহেলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়।
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সোহেল যা জানান, তা আকরাম হোসেনের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সোহেল জানান, নওগাঁ শহর থেকে অটোরিকশা নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তিনি দুজনকে পড়ে থাকতে দেখেন। কাছে গিয়ে আহত আকরামকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তাদের কী হয়েছে।
আকরাম উঠে দাঁড়িয়ে দাবি করেন, তারা আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময় রাস্তার পাশে একটি ঝোপে একটি হাতুড়ি রাখা দেখতে পান সোহেল। হাতুড়ি দেখে ভয় পেয়ে যান সোহেল।
আকরাম হাতুড়ির বিষয়টি কাউকে না জানাতে অনুরোধ করেন এবং সোহেলকে বলেন, দুবলহাটি বাজারে লোকজনকে ডেকে আনতে। সোহেল গ্রামের বাজারে গিয়ে দেখতে পান চারজন সেখানে ক্যারম খেলছিল। তাদের ঘটনাটি বলার পর তারা এসে আকরাম ও সাথীকে পড়ে থাকতে দেখে থানায় জানালে পুলিশ এসে সাথীকে মৃত অবস্থায় পায় ও আকরামকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। স্থানীয়রা সোহেলকে চিনত না।
সন্দেহজনক আসামি হওয়ায় আদালতের মাধ্যমে দুই দফায় আকরামকে ছয় দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে সাথীকে হত্যার কথা স্বীকার করেননি আকরাম। তবে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তিনি জানান, মিটলাইফ আলিকো বিমা কোম্পানিতে সাথীর নামে ৩০ হাজার করে মোট ৬০ হাজার টাকার দুটি জীবন বীমা করা আছে।
তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী শহরের সরিষাহাটির মোড়ে অবস্থিত ওই বিমা অফিসে খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। বিমা পলিসি অনুযায়ী, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে বিমাকারীর পরিবার হিসেবে স্বামী পাবেন ৪৫ লাখ টাকা আর কোনো দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে পাবেন প্রায় ৯৫ লাখ টাকা।
সাথীর ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাথীর মাথায় ভারী কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করে থ্যাঁতলে দেয়া হয়েছে।
সাথী বানুর বাবা বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার শান্তাহার পৌর এলাকার জগিপুকুর মহল্লার বাসিন্দা শহিদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে, যা প্রথমে আমরা বিশ্বাস করিনি। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর যখন জামাই আকরামকে হাসপাতালে দেখতে যাই, তখন সে স্বাভাবিক ছিল। গালে ও নাকে কয়েকটি দাগ ছিল মাত্র। কিন্তু আমার মেয়েকে যে এত বাজেভাবে মেরে ফেলবে, তা কল্পনা করতে পারিনি। যত দ্রুত সম্ভব আদালতে যেন চার্জশিট জমা দেয়া হয়। তার কঠিন শাস্তি চাই।’
সাথীর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নওগাঁ সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল বারেক নিউজবাংলাকে জানান, সোহেলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ঘটনাস্থলে গিয়ে রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ে কোনো হাতুড়ি পাওয়া যায়নি। তবে খোঁজাখুঁজি করে পাশের একটি পুকুর থেকে একটি হাতুরি উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এই হাতুড়ির আঘাতেই সাথীর মাথা থ্যাঁতলে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আকরামের বাইকের হেলমেটে যে রক্ত লেগে ছিল, সেটার ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই প্রতিবেদন হাতে পেলে তদন্তে পাওয়া সব তথ্য মিলিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা তৃতীয় স্ত্রী সাথীর এ রকম মৃত্যু আকরাম হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুর ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। সেটিও রহস্যাবৃত ছিল।
নওগাঁ পৌরসভার পিরোজপুর এলাকার জোয়ারদারপাড়ার মৃত রিয়াজ উদ্দিন জোয়ারদারের মেয়ে রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে আকরাম হোসেনের বিয়ে হয় ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি।
রাবেয়ার পরিবারের সদস্যরা জানান, রাবেয়ার গর্ভে সন্তান এলে এ নিয়ে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। কেননা আকরাম সন্তান নিতে রাজি ছিলেন না।
২০২১ সালের ২২ মে রাবেয়াকে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাড়িতে নিয়ে যায় তার পরিবারের লোকজন। এর পরদিন ২৩ মে বড় বোন রুনা লায়লা শহরের জনকল্যাণ মহল্লার বাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে যায় রাবেয়া ও তার স্বামীকে। সেই রাতেই মৃত্যু হয় রাবেয়ার।
কী ঘটেছিল সেই রাতে
পরিবারের সদস্যদের বিবরণ অনুযায়ী, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন রাবেয়ার বড় বোন রুনা ও তার স্বামী। পাশের রুমে ঘুমিয়ে পড়েন রাবেয়া ও তার স্বামী আকরাম।
রাবেয়ার বোন রুনা লায়লা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ রাবেয়া একবার চিৎকার করে ওঠে। তার পর কোনো সাড়াশব্দ আর শোনা যায়নি। পাঁচ মিনিট পর আকরামের ডাকাডাকির শব্দ শুনে ঘরে গিয়ে দেখি রাবেয়া খাটের ওপর পড়ে আছে। শরীরের নিচের অংশ ও বিছানা রক্তে ভিজে আছে। রাবেয়া কোনো সাড়া শব্দ করছিল না। আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে আকরাম বলেন, হাতের পালস চলছে না, মনে হয় মারা গেছে। স্ট্রোক করেছে। বলেই কান্নাকাটি শুরু করে আকরাম। আমরা সেই সময় বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব।’
জোয়ারদারপাড়ায় গিয়ে কথা হয় রাবেয়ার বড় ভাইয়ের ছেলে আশিকুল আলম অলির সঙ্গে। অলি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফুপু মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আমরা সবাই বড় ফুফুর বাড়িতে যাই। ফুপুকে হাসাপাতালে নিতে দেননি আকরাম ফুফা। এর কিছুক্ষণ পর সবুজ নামের ফুপার এক আত্মীয় ফোন করে বলে যে তোমার বড় ফুপুর বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল বা থানায় গেলে তোমাদেরই সমস্যা হবে। পরিস্থিতি এমন করে ফেলেছিল যে আমরা কী করব, বুঝতেছিলাম না।’
নিজ স্ত্রীকে কেন তিনি মেরে ফেলতে যাবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রাবেয়ার ভাই বাবলু জোয়ারদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বোনের নামে কাঁঠালতলী বাজার এলাকায় আমরা ৯ শতক জমি লিখে দিয়েছিলাম বিয়ের অনেক আগে। সেই জমির বাজারমূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকার ওপরে। আকরাম বারবার সেই জমি বিক্রি করা জন্য চাপ দিচ্ছিল রাবেয়াকে। রাবেয়া রাজি হচ্ছিল না। এ ছাড়া পরে আমরা জানতে পারি গ্রামীণ ব্যাংক দুবলহাটি শাখাসহ আরো দুই থেকে তিনটি এনজিও সংস্থা থেকে রাবেয়ার নামে ঋণ নেয়া ছিল প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো। এসব ঋণ মাফ হয়ে যাবে যদি ঋণগ্রহীতা মারা যায়।’
থানায় কেন অভিযোগ বা মামলা করেননি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার সময় আমরা কী করব, বুঝতেছিলাম না। আর নানাভাবে আমাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল। পরে যখন আকরামের কুকীর্তি বুঝতে পেয়েছিলাম বা সন্দেহ হয়েছিল, তখন আমরা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই এটাই ভাবছিলাম যে রাবেয়া তো চলেই গেছে পরপারে, এখন মামলা করলে আবার লাশ কবর থেকে উঠাবে। তার রুহের কষ্ট হবে। এই ভেবে মনকে বুঝ দিয়ে আছি। তৃতীয় স্ত্রী সাথীকে হত্যার অভিযোগে জেলে আছে শুনেছি। আশা করছি সেই মামলায় তার বিচার হবে।’
প্রথম স্ত্রী লাভলী সুলতানার মৃত্যুও কি স্বাভাবিক
শহরের লাটাপাড়া শাহি জামে মসজিদ এলাকার মৃত আহম্মেদ কাজীমুদ্দিনের মেয়ের সঙ্গে ২৩ বছর আগে বিয়ে হয় আকরামের। ঘটনার দিন ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাত ১১টা। আকরামের ছেলে আলামিন লুইস ঘটনার সময় ছিলেন নওগাঁ শহরের হাসপাতাল মোড় এলাকার একটি মেসে। পড়াশোনা করতেন নওগাঁ সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে।
যখন লাভলীর মৃত্যু হয় তখন আকরাম ও লাভলী নিজ বাড়িতে ছিলেন। হঠাৎ করেই চিৎকার করে ওঠেন আকরাম। এ সময় আকরামের প্রতিবেশীরা এসে দেখতে পায় লাভলী বিছানার ওপর মরে পড়ে আছেন। আকরাম লাভলীর পরিবার ও স্থানীয়দের জানান, হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছেন তার স্ত্রী। এ নিয়ে থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় লাভলীর ছেলে আলামিন লুইসের সঙ্গে। অনেক চেষ্টার পর কিছু কথা বলতে রাজি হন লুইস। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সে সময় শহরে মেসে ছিলাম। রাত সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আমার মা মারা যায়। আর আমাকে ও আমার মামার বাড়ির লোকজনকে মায়ের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে।’
লুইস বলেন, ‘মা যদি স্ট্রোক করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগত। চেষ্টা করতে হতো মাকে বাঁচানোর। আর যখন মাকে দাফন করা হয়, সেই দিন পল্লী শিশু ফাইন্ডেশন, গ্রামীণ ব্যাংক এবং আশা এনজিও থেকে লোকজন এসেছিল। মায়ের নামে ২ থেকে ৩ লাখ টাকার মতো ঋণ নেয়া ছিল। তখন এনজিওর লোকেরা বলেছিন, মারা যাওয়ার কারণে আর ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। আকরাম আমার বাবা আর লাভলী আমার মা। আমি কোন দিকে যাব, বুঝে উঠতেই পারিনি। মা তো সুস্থই ছিল।’
কী বলছে পুলিশ
লাভলী ও রাবেয়ার মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সাথীর মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করছি। তাতে দেখা যায় সাথীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও কিছু সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে পেলে আমরা আদালতে চার্জশিট দাখিল করব।’
তিনি আরো বলেন, ‘আকরাম হোসেনের প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়ে থানায় নিহতের পরিবারের কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ দিলে তদন্ত করতে সুবিধা হতো। আগের দুই স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবুও আমরা সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করার উদ্যোগ নিব। তবে এখন আমাদের ফোকাস সাথীর মৃত্যু।’