গত ৬০ বছরের বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও সুন্দরবনে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে বিভিন্ন বৃক্ষের প্রজাতির ভিন্নতায় অভিযোজনের তারতম্য দেখা গেছে বলে জানিয়েছে একটি গবেষণা।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনের ওপর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে এমন কথা জানান গবেষকরা।
রোববার দিনব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে সুন্দরবনের ওপর বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততা ও তাপমাত্রার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এছাড়া সুন্দরবন নিয়ে চলমান প্রকল্পের বাস্তবায়ন অবস্থা উপস্থাপন ও বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন।
তার নিজের বেশ কয়েকটি গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনের সব অংশের লবণাক্ততা এক রকম নয়, পরিস্থিতি ক্রম বিস্তারও এক নয়, পানিপ্রবহের ধরন, মাটি গঠন ও তাতে জৈব উপাদানের উপস্থিতির তারতম্য রয়েছে। বিগত ৬০ বছরের বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও লবণাক্তার পরিমাণ বেড়েছে। সে কারণে বৃক্ষরাজির মধ্যে প্রজাতির ভিন্নতায় অভিযোজনের তারতম্য বেশ লক্ষণীয়।’
সুন্দরবনের কার্বন শোষণ ক্ষমতার ওপর আরও গবেষণার প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ড. মাহমুদ হোসেন আরও বলেন, ‘সুন্দরবন নিয়ে নানামুখী গবেষণা হচ্ছে, নানা উদ্যোগ ও প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে, তথ্য-তত্ত্ব আহরণ করা হচ্ছে। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে হওয়ায় অভিলক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীনও হতে হচ্ছে।
‘তাই সময় এসেছে আর দেরি না করে সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা বা কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থার যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের। যাতে করে সকল সংস্থার মধ্যে আন্তঃসংযোগ, তথ্য-তত্ত্ব বিনিময় ও পরামর্শ-দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। ইকোলজিক্যাল মডেলিং ও ডাটা এনালাইজিং করে ইকো সিস্টেম নিয়ে আরও বিশদ গবেষণা করা যায়।’
সেমিনারে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বন বিভাগ, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য বিভাগ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, জিআইজেডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সুন্দরবন নিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে গবেষণা, কার্যক্রম বাস্তবায়ন, উদ্যোগ ও পরিকল্পনা এবং তথ্য-তত্ত্ব তুলে ধরেন।
সেখানে উপস্থাপিত বিভিন্ন গবেষণা নিবন্ধ ও থেকে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানামুখী বৈরী অভিঘাত সত্ত্বেও সুন্দরবন আপন মহিমায় টিকে আছে। এর আয়তনও বাড়ছে। তবে গত ৫০-৬০ বছর বা ততোধিক সময়ের তথ্য-উপাত্ত বলছে- সুন্দরবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন দৃশ্যমান।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোনো কোনো প্রজাতির (গেওয়া, গরানসহ) বৃক্ষ-গুল্মের বৃদ্ধির প্রবণতা আশাব্যঞ্জক অবস্থায় রয়েছে। আবার কোনো কোনো প্রজাতির (সুন্দরীসহ) ওপর অনেকটাই বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নির্বিচারে সন্নিহিত এলাকার নদী ও খালে চিংড়ির পোনা আহরণে মৎস্য প্রজনন, বিস্তার ও বংশ রক্ষায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে গবেষণায় বলা হয়।
গবেষণায় আরও বলা হয়, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থান, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং এই ম্যানগ্রোভ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ওপরও জোর দেয়া হয়। সুন্দরবনে পর্যটকদের আগমন বাড়ছে কিন্তু প্রকৃত অর্থে ইকো-ট্যুরিজম বলতে যা বোঝায় সেটা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। সুন্দরবনে পর্যটনে গিয়ে লাউড স্পিকার ব্যবহার করায় বন্যপ্রাণী ও পাখির আবাস, প্রজনন ও বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটছে।
এ সময় পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপন করে আলোচনা করেন অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চের প্রতিনিধি ড. নোরা ডেভো।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণায় সে দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার আগ্রহের কথা উল্লেখ করে জানান, ইতোমধ্যে দুই মিলিয়ন ডলারের গবেষণা সহায়তা প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে তিনি দৃঢ় আশাবাদী।
এ ছাড়া সেমিনারে সুন্দরবনের নতুন মানচিত্র ও সুন্দরবন মিউজিয়াম তৈরি এবং প্রাকৃতিক উপায়ে সুন্দরবন বহির্ভূত এলাকায় সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির চারা লাগিয়ে ইতোমধ্যে গত কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় ২ লাখ ৯ হাজার হেক্টর জমিতে বন সম্প্রসারণের সাফল্যের তথ্য তুলে ধরা হয়।
তা ছাড়া সুন্দরবনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে মেরিন অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচার রিসার্চের প্রতিনিধি প্রফেসর অ্যান ফ্লেমিং, আইইউসিএন (এশিয়া অঞ্চল) এর সাবেক পরিচালক ড. জাকির হোসেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজির প্রফেসর ড. মো. নাজমুল আহসান, অর্থনীতির প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হায়দার ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভারনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. স্বপন কুমার সরকার, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপ-প্রধান বন সংরক্ষক মো. জহির ইকবালসহ আরও অনেকেই।