‘অবরোধে মোগো (আমাদের) মাছ সব ভারতীয়রা ধইর্যা লইয়া (ধরে নিয়ে) যায়। মোগো মাছ মোরা (আমরা) ধরতে পারি না। সরকাররে কই, মোগো চাউল লাগবে না, ভারতীয়গো মাছ ধরা ঠ্যাকান।’ এ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের বাদুরতলা এলাকার জেলে সেলিম মাঝি।
ইলিশ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর তিনি অন্য জেলেদের মতো বেকার সময় কাটাচ্ছেন। আশঙ্কা করছেন, অবরোধ শেষে সাগরে নেমে আর মাছ পাবেন না। কারণ অবরোধ চলাকালে ভারতীয় ট্রলার সাগরে নামে, সেখানকার জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যায়।
সেলিম জানান, মৌসুমের শুরুতে ৬৫ দিন ও মৌসুমের শেষের দিকে আরও ২২ দিন- মোট ৭৭ দিন বসে থাকতে হয়।
তিনি বলেন, ‘এবার তেমন সুবিধা হয়নায় সাগরে, তয় নদীতে কিছু ইলিশ পাইছে। এহন (এখন) অবরোধ যাওনের পর সাগরে নাইম্মা যদি মাছ পাই, তয় খাইয়া পইড়্যা থাকতে পারমু।’
উপকূলীয় এলাকার সাধারণত দুই ধরনের জেলেরা থাকেন। এক ধরনের জেলেরা মৌসুমের সময় গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকারের আশায় বছরের বাকিটা সময় বেকার থাকেন। আর প্রান্তিক জেলেরা স্থানীয় নদ-নদীতে ছোট নৌকায় দল বেধে মাছ শিকার করেন।
এর মধ্যে যারা নিবন্ধিত জেলে, তারা ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি খাদ্য সহায়তার আওতায় থাকেন। তবে তাদের অনেকেই কথা, খাদ্য সহায়তার চেয়ে বেশি জরুরি এখন ভারতীয় জেলেদের আটকানো।
গভীর সমুদ্রগামী জেলে সিদ্দিকুর রহমান আকন বলেন, ‘মোরা যহন সরকারের কতা (কথা) মাইন্না (শুনে) মাছ ধরা বন্ধ রাহি, তহন ওরা (ভারতীয় জেলেরা) আমাগো সাগর চইষ্যা বেড়ায়। বড় বড় ট্রলিতে (ট্রলার) মাছ ধইর্যা লইয়্যা যায়। এইয়া (এটা) না ঠেহাইতে পারলে কোনো কাম অইবে না।
‘সরকার দুগ্গা (একটু) চাউল দেয়, হেইয়াও সোমায়মতো (সময়মতো) পাই না। মোরা না খাইয়া থাকতেও রাজী আছি তোমো (তবুও) ওগো মাছ ধরা যেন সরকার ঠ্যাকাইয়া রাহে।’
বরগুনা জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মাঝি বলেন, ‘আমাদের জেলেরা সরকারের আইন মেনে নিষেধাজ্ঞার সময় বেকার বসে থাকে। আমরা শ্রমিক ইউনিয়ন জেলেদেরকে নিষেধাজ্ঞা শতভাগ মানার পরামর্শ দেই। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে, ভারতীয় জেলেরা এ সময়টাতে সাগরে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যায়।
‘এটা প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা নিষেধাজ্ঞার সুফল থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হব। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, নিষেধাজ্ঞাকালে ভারতীয় জেলেরা আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যেতে না পারে।’
বাংলাদেশ ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরি বলেন, ‘আমরা গোটা মৌসুমের একটা বিরাট সময় নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকি। এ সময় ভারতীয়রা অবাধে আমাদের মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আমরা কথা বলেছি।
‘জেলেরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে ভারতীয় জেলেদের ইলিশ শিকার নিয়ে। গত দুই বছরে বেশ কিছু ভারতীয় জেলে আমাদের সমুদ্রসীমায় আটকও হয়েছে। কিন্ত তারপরও তাদের ঠ্যাকানো যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে আমাদের কোস্টগার্ড ও নৌ-বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। টহল জোরদার করতে হবে। আমি আশা করি এবার সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’
কোস্টগার্ড সদর দপ্তরের (ঢাকা) মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা এর আগেও বেশ কিছু ভারতীয় জেলেদের আটক করেছি। এবার নিষেধাজ্ঞার সময় আমাদের সমন্বিত টহল থাকবে। কেউ যাতে মাছ শিকারের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। ভারতীয় জেলেদের আমাদের সমুদ্রসীমায় মাছ শিকারের কোনো সুযোগ দেয়া হবে না।’
জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় ধরায় গত ৬ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে মাছ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এ সময়ে জেলেদের মাছ না ধরার জন্য সচেতন করতে চলছে মাইকিং।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, এই ২২ জেলা মৎস্য অধিদফতর, কোস্টগার্ড, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং স্থানীয় মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে ব্যাপকভাবে অভিযান চলবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলবে।
তিনি বলেন, ‘ভারতীয় জেলেদের ইলিশ শিকার বন্ধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নৌ-বাহিনী ও কোস্টগার্ডের বৈঠক হয়েছে। আশা করি এবার কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে পাড় পাবে না।’