একের পর এক আগুনমুখো ফানুস উড়ে যাচ্ছে আকাশে। বর্ণিল কাগজে তৈরি বিচিত্র আকারের এসব ফানুসের কোনোটিতে ধর্মীয় চিহ্ন আঁকা, কোনোটিতে লেখা শান্তির বাণী। শত শত ফানুসের আলোয় বর্ণিল হয়ে ওঠেছে আকাশ।
সাধু সাধু আওয়াজে ফানুস ওড়ানোর মহৌৎসব পালনে প্রায় ৫০টি জমকালো প্যান্ডেল তৈরি করেছে বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগঠনগুলো। এসব প্যান্ডেলের মূল আকর্ষণ বুদ্ধ। ঢেলে সাজানো হয়েছে বিহারগুলোকেও।
শুধু তাই নয়, প্রবারণা ঘিরে বৌদ্ধপল্লীর প্রতিটি বাড়িতেই এখন উৎসবের আমেজ।
শনিবার সন্ধ্যায় প্রবারণা পূর্ণিমার প্রথম দিনে কক্সবাজার শহরের জাদিরাম, পিটাকেট, থংরো ও অগ্গমেধা ক্যাং সংলগ্ন কেন্দ্রীয় মাহাসিংদোগ্রী মন্দির প্রাঙ্গণে স্বর্গের উদ্দেশে উড়ানো হয় শত শত ফানুস।
পরিশুদ্ধ জীবনের প্রার্থনায় এ সময় মন্দির প্রাঙ্গণে বৌদ্ধ ছাড়াও মিলিত হন হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের হাজারও মানুষ।
রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতারা জানান, শনিবার বিকাল থেকে রাখাইন সম্প্রদায়ের অসংখ্য নারী-পুরুষ নতুন পোশাক ও উন্নতমানের খাবার নিয়ে বিহারে গমন করেন। সেখানে সুখ-শান্তি ও মহামারি থেকে মুক্তি কামনায় প্রার্থনা করেন তারা।
এবার মাহাসিংদোগ্রী মন্দিরে প্যান্ডেল করেছে কক্সবাজার সরকারি কলেজ বৌদ্ধ ছাত্র মৈত্রী, সিটি কলেজ বৌদ্ধ ছাত্র মৈত্রী, রাখাইন একতা সংঘ, বড় বাজার রাখাইন যুব সংঘ, বাংলাদেশ রাখাইন স্টুডেন্ট কাউন্সিল, ফ্রি স্টাইল রিলেশনশিপ, রাজধানী ফ্রেন্ডস সার্কেল, রাখাইন যুব ইউনিটি, হ্যাংগিং গার্ডেন, কে আর ভিক্টোরিয়া, রাখাইন তরুণ সংঘ ও বৌদ্ধ মৈত্রী পরিষদ।
কক্সবাজার রাখাইন একতা সংঘের সভাপতি উসেন থোয়েন (উসেনমি বাবু) বলেন, ‘সিদ্ধার্থ যখন বোধিসত্ত্ব রূপে শ্রবস্তী নগর থেকে গৃহত্যাগ করেন, তখন অনুমাদ্ধর্শী নদীর তীরে অবস্থানকালে নিজের চুল কেটে উপরের দিকে ছুড়ে মারেন। সেই চুল গুচ্ছ মহাতাবতিংস সাগ্রে প্যাগোডা হিসেবে স্থির আছে। তাই চুলামনি নামে প্যাগোডার উদ্দেশেই পূজা এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করতে ফানুস ওড়ানো হয়ে থাকে।’
বুদ্ধের স্মৃতিকে অমলিন রাখতেই কক্সবাজারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন করছে বলে জানান উসেন থোয়েন।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা উ থান্ট অংক বলেন, ‘প্রবারণার মূল প্রতিপাদ্য আত্মশুদ্ধি, শুভ, সত্য ও সুন্দরকে বরণ করে অসত্য ও অসুন্দরকে বর্জন করা। আমি কামনা করি, মানুষের অন্তর থেকে সব মলিনতা দূর করে অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, প্রেম ও দয়া জাগ্রত হবে।’
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ওমেং রাখাইন বলেন, ‘তিন মাস বর্ষাবাস (উপোস) থাকার পর মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায় উৎসাহ-উদ্দীপনায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা পূর্ণিমা) উৎসব পালন করে।
‘প্রচলিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় তার মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমার এই তিথিতে আকাশে উড়ানো হয় ফানুস বাতি।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু সুফিয়ান বলেন, ‘সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতিতে আমরা বিশ্বনব্যাপী অনন্য। সব ধর্মের মানুষের যে উৎসব তা এখানে ফুটে ওঠেছে। আমরা চেষ্টা করি, সকল ধর্মের মানুষের উৎসবে আয়োজনে সহযোগী হতে।’
জেলার মহেশখালী, উখিয়া, চকরিয়া, রামু, পেকুয়া, টেকনাফ উপজেলা ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতেও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপিত হচ্ছে।
আগামী সোমবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও রামু বাঁকখালী নদীতে কল্প জাহাজ ভাসার মধ্য দিয়ে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।