কাজে দেরি হলেই মোটা লাঠি দিয়ে পেটাত। চামচ ও খুন্তি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে খোঁচা দিত। জোর করে থুথু ও প্রস্রাবও খাওয়াতো আমাকে। কথা বলতে দিত না বাবা-মায়ের সঙ্গে।
শনিবার এভাবেই গৃহকর্ত্রীর বাড়িতে নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রাবেয়া আক্তার ওরফে আকলিমা।
১৭ বছর বয়সী আকলিমা মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামের সুলতান মোল্লার মেয়ে। ২০১৫ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে রাবেয়াকে একই গ্রামের জালাল হাওলাদারের মাধ্যমে খুলনার নিরালা এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক এসএম সামছুল হকের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায় তার বাবা-মা।
সেখানে ৫ বছর কাজ করার পর সিলেটে সামছুল হকের মেয়ে তানিয়া সুলতানা লাকির কাছে পাঠানো হয় রাবেয়াকে। তিন মাস পর সেখান থেকে তাকে ঢাকার মিরপুরে ছোট বোন নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় পাঠিয়ে দেন লাকি।
এতদিন ভালো থকলেও, নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় আসার পর অমানুষিক নির্যাতন শুরু হয় রাবেয়ার ওপর।
তিন বছর নির্যাতন সহ্য করে, প্রাণ বাঁচাতে শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় গত ৫ অক্টোবর লিজার ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে মোরেলগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে আসেন রাবেয়া।
শুক্রবার বিকেলে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় তাকে।
চিকিৎসাধীন রাবেয়ার হাত, পা, মুখমণ্ডল, ঘাড়-পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বলও তিনি।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শর্মী রায় বলেন, ‘ওই কিশোরীর সারা শরীরেই ক্ষতচিহ্ন। এগুলো বেশ পুরাতন। শার্প কাটিং কোনো ক্ষত নেই। সবই ব্ল্যাংক হুইপেন (লাঠি বা এই ধরনের কিছু) দিয়ে আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হয়েছে। মানসিকভাবেও সে বিপর্যস্ত।’
হাসপাতালের বিছানায় বসে নির্যাতনের শিকার রাবেয়া বলেন, ‘সামছুল হক স্যার ও তার বড় মেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু তার ছোট মেয়ে অন্যরকম। প্রতিটা কাজে সময় বেঁধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবাকি করত।
‘একদিন ওয়ারড্রপের উপর টিকটিকির মল পাওয়ায় আমাকে মুখ দিয়ে পরিষ্কার করায়। আমার মা মারা গেলেও বাড়ি আসতে পরিনি। ওই ম্যাডামের স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর মাহফুজুর রহমান স্যারের পোস্টিংয়ের কারণে সৈয়দপুর, ঘাটাইল, সাভার, রংপুর হয়ে ঢাকার বাসায় কাজ করছি।
‘কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হত না। পেটে ভাতে কাজ করতাম। বড় করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে- এমন কথা বলে অনেক ছোট বেলায় বাড়ি থেকে কাজে পাঠানো হয়েছিল।’
রাবেয়া আরও বলেন, ‘আমাকে প্রচুর মারধর করতো। লাঠি, খুনতি দিয়ে পেটাত। দেয়ালে মাথা ঠেস দিত। সব সময় একটা ভয়ে থাকতাম। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছি।
‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে এমন যেন আর কারো জীবনে না হয়। আমার মা নেই। মায়ের শেষ স্মৃতি একটা নাক ফুল আছে ওই বাসায়। আপনারা আমাকে ওইটা এনে দেন’- বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রাবেয়া।
রাবেয়ার বড় বোন হামিদা বেগম বলেন, ‘বাবার দুই বিয়ে। প্রথম ঘরে আমরা চার বোন। পরের ঘরে ৭ বোন, দুই ভাই। অভাবের কারণে ওকে কাজ দেই। বছরে এক দুই বার কথা হতো। আমরা জানতাম সে রংপুরে আছে। ঢাকায় আছে এই কথা আমাদের জানানো হয়নি।’
চাচা কাঞ্চন মোল্লা জানান, রাবেয়ার বাবা এখন মৃত্যু শয্যায়। গত বুধবার তার বাবার কাছে ফোন করে বলা হয়- ঢাকার বাসা থেকে রাবেয়া পালিয়েছে।
পরে রাবেয়া নিজ বাড়িতে ফিরলে তার পুরনো গৃহকর্তা সামছুল হককে ফোন করে জানানো হয়। পরে তিনি এসে চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দেন এবং আরও ৬০ হাজার টাকা দেয়ার আশ্বাস দেন।
সাংবাদিক পরিচয়ে পুলিশ পরিদর্শক সামছুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দাবি করেন, রাবেয়া তার মেয়ের বাসা থেকে অনেক মালামাল নিয়ে গত বুধবার পালিয়ে এসেছে। মিরপুর থানায় এমন অভিযোগে একটি জিডিও করা হয়েছে।
এ সময় রাবেয়ার চিকিৎসায় টাকা দেয়ার কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে তাকে কিছুটা মারধর করেছে। তাই মানবিক কারণে মোরেলেগঞ্জে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি।’