জুলাই থেকে ঘটা করে শুরু হওয়া বিদ্যুতের লোডশেডিং পরিস্থিতি সেপ্টেম্বরের শেষে কিছুটা উন্নতির আভাস দিয়ে মঙ্গলবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর থেকে যাচ্ছে-তাই হয়ে গেছে। ভোর, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, গভীর রাত- বিদ্যুৎ যাচ্ছে যখন তখন। বিশেষ করে মধ্যরাতের লোডশেডিং বেশি বিরক্তির কারণ হচ্ছে।
এক যুগ ধরে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষমতা, দেশের শতভাগ এলাকাকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার পর উৎসবের মধ্যে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে।
জুলাইয়ে যখন সংবাদ সম্মেলন করে লোডশেডিংয়ের কথাটি জানানো হয়, তখন এতটা ভোগান্তির বিন্দুমাত্র আভাসও দেয়া হয়নি। বরং একেক এলাকায় সূচি করে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হলে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন কেন করতে হবে, এ নিয়েও কথা হচ্ছিল। তবে প্রথম দিন থেকেই দেখা যায়, এই সূচির বাইরেও বিদ্যুৎ যাচ্ছে যখন-তখন।
সে সময় তীব্র গরমে জীবন ছিল উষ্ঠাগত। ভরা বর্ষায় দেখা মিলছিল না বৃষ্টির। আবহাওয়ার এই উত্তপ্ত হয়ে উঠার মধ্যে বিদ্যুতের যাওয়া আশায় তীব্র ভোগান্তির মধ্যে প্রথমে জানানো হয় সেপ্টেম্বরের শেষে এবং পরে জানানো হয় অক্টোবর থেকে লোডশেডিং সহনীয় হয়ে আসবে।
আবহাওয়া এখন আর আগের মতো অতটা গরম নয়, ফলে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে কিছুটা। লোডশেডিং কিছুটা কমেও আসছিল। এর মধ্যে গত ৪ অক্টোবর দুপুরে হঠাৎ করে বিদ্যুৎহীন হয়ে যায় দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা। সেদিন দেশের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড ফেল করার পর ঘণ্টা আটেক সময় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটায় দেশের কোটি কোটি মানুষ।
সেদিন রাত ১০টার মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হলেও পরদিন থেকে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। বিপর্যয়ের আগে যেখানে দিনে এক বা দুইবার বিদ্যুৎ যাচ্ছিল, সেখানে এই সংখ্যাটি চার বা পাঁচ বা ছয়ে গিয়ে ঠেকছে। কখনও আধা ঘণ্টা, কখনও এক ঘণ্টা, কখনও তার চেয়ে বেশি সময় বিদ্যুৎহীন অবস্থায় কাটছে সময়। এমনকি রাত আড়াইটা, সাড়ে তিনটা-এমন সময়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বৈদ্যতিক পাখা। যাদের বাড়িতে বিকল্প ব্যবস্থা করা নেই, তাদের ঘুম উধাও হয়ে যাচ্ছে লোডশেডিংয়ে।
এই পরিস্থিতি থেকে কবে উত্তরণ হবে, তা জানেন না বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, যদিও গত ৭ আগস্ট তিনি বলেছিলেন, অক্টোবর থেকে আবার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে।
চাহিদা ও উৎপাদনের হিসাব মিলছে না
জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ২২ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। চাহিদাও ছিল সমান।
এরপর দিনে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতে থাকে। গরম কমে আসার পর ধীরে ধীরে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধানও কমতে থাকে।
গ্রিড বিপর্যয়ের আগের দিন ৩ অক্টোবর দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৭৩৬ মেগাওয়াট, উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৮১২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ লোডশেডিং ছিল ৯২৪ মেগাওয়াট।
কিন্তু গ্রিড বিপর্যয়ের পরদিন বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৫৩৫ মেগাওয়াট আর উৎপাদন হয়েছিল ৮ হাজার ১০৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করতে হয় ছিল ৪ হাজার ৩৯৫ মেগাওয়াট।
সেখান থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উত্তরণর কথা জানা যায় বিদ্যুৎ বিভাগের পরিসংখ্যানে। গত শুক্রবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৯৫০ মেগাওয়াট, আর উৎপাদন ১১ হাজার ৯০৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ৯৬৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের আগের পর্যায়ে নেমে এসেছে।
তাহলে কেন বিদ্যুতের এই যাওয়া-আসা- এমন প্রশ্নে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রিড বিপর্যয়ের পর লোডশেডিং একটু বেড়েছে। কারণ, বিপর্যয়ের পরে ৯৯ শতাংশ ঠিক হলেও কিছু কিছু জায়গায় এখনও পাওয়ার প্ল্যান্ট স্টার্ট করতে সময় নেবে। এজন্য পরিস্থিতি আরও একটু খারাপ হয়ে গেছে।’
আবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সারা দেশে এক হাজার মেগাওয়াটের কম ঘাটতির তথ্য দিলেও রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার একটি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি- ডিপিডিসির ব্যবস্থাপক বিকাশ দেওয়ান জানিয়েছেন, কেবল তাদের আওতাধীন এলাকাতেই ঘাটতি চার শ মেগাওয়াট।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যদি আজকের দিনের কথা বলি, তবে বন্ধের দিনে আমার চাহিদা ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু আমি পাচ্ছি ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। তার মানে ৩৫০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট ঘাটতি রয়েছে।
‘১০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হলে আমরা বলে দিতাম এই এলাকায় লোডশেডিং হবে, ২০০ মেগাওয়াট হলেও আগে-ভাগে বলতে পারতাম কোথায় লোডশেডিং হবে। তবে যখন ৪০০ বা ৪৫০ মেগাওয়াট হয়, তখন কঠিন হয়ে যায়। কারণ, আমাদের বলা হয়েছে এমন লোড বেশি হলে আবার একটা ব্লাক আউট হয়ে যেতে পারে।’
ডিপিডিসে ছাড়াও ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে আরও একটি সংস্থা আছে, সেটি হলো ডেসকো। এর আওতাধীন এলাকাতেও লোডশেডিং পরিস্থিতি একই রকম। সেখানেও কয়েক শ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকে।
গ্রাহকেরা বিরক্ত
সংবাদকর্মী রাজু আহমেদ তার এলাকায় কতবার বিদ্যুৎ যাচ্ছে তার একটি হিসাব রাখছেন। বৃহস্পতিবারের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘গভীর রাত থেকে বিদ্যুৎ খালি আসি-যাই করতেছে। রাত তিনটায় গেল প্রথম, ছিল না একঘণ্টা। এরপর গেল সকাল নয়টায়, এলো ১০টা সাতে; তৃতীয়বার গেল ১টা তিনে, এলো ২টা পাঁচে; তারপর ২টা আট চল্লিশে, এলো ২টা ছাপ্পান্নতে; শেষবারের মতো গেল ৪টা পঁয়ত্রিশে, এলো ৫টা পাঁচে!
‘তাইলে দাঁড়ালো কি! …লোড শেডিং হইলো গিয়া ৩ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট। দিনের বাকি এখনো সাড়ে ৬ ঘণ্টা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থাকে না এক ঘণ্টা। তার মানে কী? এখন থেকে লোডশেডিং হইব ৫ ঘণ্টা!
‘গ্রামের অবস্থা কে জানে!’
শুক্রবার তার এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎ গেছে পাঁচবার। সেদিন তিনি লেখেন, ‘পঞ্চমবারের মতো সন্ধ্যা ৭টায় তিনি আবারও গেলেন! আগে ছিলেন না ৩ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট!’
সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা মৌসুমী রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন কারেন্ট চলে গেছে প্রতিবার এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় থাকছে না। এটা আগে দিনে একবার হলেও এখন সেটা কয়েকবার হয়েছে।’
শান্তিনগরের বাসিন্দা রাফিকা আক্তার বলেন, ‘দিনে কমপক্ষে তিন থেকে চার বার যাচ্ছে। রাতে সন্ধ্যার পর একবার চলে যায়। মাঝে মধ্যরাতে না গেলেও গত দুই তিন ধরে মধ্যরাতেও বিদ্যুৎ থাকে না।’
নাখালপাড়ার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আগে দিনে একবার করে যেত। এখন দুইবার করে যাচ্ছে। প্রতিবার গেলে কমপক্ষে এক ঘণ্টা পর আসে।’
বনশ্রীর বাসিন্দা ফাওমিদা আক্তার বলেন, ‘খুব সকালে কারেন্ট থাকে না। এরপর দুপুরের পর আবার লোডশেডিং থাকে। তবে মধ্যরাতে গেলে এক ঘণ্টার বেশি সময় লোডশেডিং থাকে। এটাই কষ্টকর বেশি।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা এস এম আল মামুন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় চারবার লোডশেডিং হয়। আর প্রতিবার এক ঘণ্টা। দিনেই তিনবার থাকে না। রাতে তো একবার যাবেই।’
মিরপুরের আনসার ক্যাম্পের সিরাজুল আরেফীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার করে যায় দিনের বেলা। একবার গেলে এক ঘণ্টা। রাত ১২টার পর একবার করে যাবেই। এটা সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর।’
উত্তরণ কবে, জানেন না বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী
লোডশেডিংয়ের উন্নতি হবে হবে- এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্যাস নেই আমাদের, এজন্য কয়েকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করে দিয়েছি। জানি না কবে ঠিক হবে। গ্যাস যখন পাব তখন ঠিক হবে।’