প্রতিদিন নৌকা ও ট্রলারে করে পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে কাজে যেতে কার ভালো লাগে? তার ওপর আবার প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা, রাতে বিপদে পড়লে তো নদী পার হওয়া মহাসমস্যা।
পোশাক কারখানার শ্রমিক রমজান মিয়া বললেন, ‘বছরের পর বছর এই কষ্ট সইছি। দুর্ভোগের দিন শেষ হইতাছে। ব্রিজ চালু হইতাছে মানে স্বপ্ন পূরণ হইতাছে।’
আগামী সোমবার চালু হতে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে বন্দর উপজেলাকে আলাদা করে রাখা শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু। ফলে নৌকা ও ট্রলারে ভোগান্তি নিয়ে নদী পারাপার হওয়ার এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের কষ্টের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে দুটি এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থার।
২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বন্দরের মদনগঞ্জ ও সদরের সৈয়দপুর এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার নাম দেয়া হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু।
প্রায় সোয়া কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬০৮ কোটি টাকা। ছয় লেনের এই সেতুর চারটি লেনে চলবে দ্রুতগতির যান, বাকি দুটি দিয়ে চলবে রিকশা-সাইকেলের মতো ধীরগতির বাহন। দুই পাশের রেলিং ঘেঁষে রয়েছে ফুটপাত। তাই হেঁটেও পাড়ি দেয়া যাবে।
সেতুটি চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের সঙ্গে পদ্মা সেতুর দূরত্ব কমবে ৯ কিলোমিটার। তখন বন্দর উপজেলার মদনপুর দিয়ে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর হয়ে শ্রীনগরের ছনবাড়ি পয়েন্টে সেতুর সড়কপথ যুক্ত করবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সুপার এক্সপ্রেসওয়েকে।
সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই সেতুর উদ্ধোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।’
ঘটা করে সেতুর উদ্বোধনের প্রস্তুতি শেষ করেছে জেলা প্রশাসন। উদ্বোধনের দিন দুই পারে থাকবে হাজারো মানুষ। সাজানো হবে সেতুসহ দুই পারের পথ।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিস বলেন, ‘এ সেতুটি নির্মাণের কারণে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অগ্রগতি যেমন হবে, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহনগুলো চট্টগ্রাম যেতে এ সেতু ব্যবহার করলে সময় বাঁচবে, কমবে যানজট।’
সড়ক ও জনপদ বিভাগের নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী ইকবাল জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোগড়াপাড়া ও মদনপুর এবং ঢাকা সিলেট মহাসড়কের যানবাহনগুলো এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক হয়ে সরাসরি বন্দরের রাস্তায় উঠবে। এরপর মুক্তারপুর হয়ে পদ্মা সেতুর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সুপার এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ছনবাড়ী পয়েন্টে সংযুক্ত হতে পারবে। ফলে এসব পথের যানবাহনের সময় বাঁচবে প্রায় দুই ঘণ্টা।
নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জবাসীর উন্নয়নে নাসিম ওসমান সেতু, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড সম্প্রসারণ, নারায়ণগঞ্জে ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল কলেজ, নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত ফ্লাইওভারসহ আরও অনেক কিছু দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব কাজ হয়ে গেলে আমরা ঢাকাকে বলব, আপনারা নারায়ণগঞ্জে এসে দেখে যান আমরা কারা।’
স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় খুশি বন্দরবাসী
সেতু খুলতে যাওয়ায় আনন্দের সাগরে ভাসছে বন্দরের মদনগঞ্জের বাসিন্দা লিটন মিয়া। তিনি বলেন, ‘মদনগঞ্জ থেকে বন্দর হয়ে পত্রিকা নিয়ে যেতে হয় মুন্সীগঞ্জে। সব মিলিয়ে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। এখন সাইকেল চালিয়ে সহজে যেতে পারব। বাঁচবে সময় ও টাকা। দীর্ঘদিনের কষ্ট শেষ হচ্ছে।’
বন্দরের ফরাজিকান্দা এলাকার রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী জনি মিয়া বলেন, ‘সেতুটি শুধু আমাদের নয়, সারা দেশের মানুষের উপকারে আসবে। এখান থেকে মুন্সীগঞ্জ দিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে অনেক জেলায় যাতায়াত সহজ হবে। তাছাড়া কাঁচামাল ও সবজি আনা-নেয়ায় এ পথ অনেক সহজ হবে। পরিবহন খরচ কম লাগবে। আশা করি, বাজারেও এর প্রভাব থাকবে।’
নারায়ণগঞ্জ পাড়ের সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা রিয়া আক্তার বলেন, ‘এখান দিয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া যাবে সহজে। সবচেয়ে বেশি উপকার হবে রোগীদের। এলাকার উন্নয়নও বাড়বে।’
অর্থনীতি চাঙা হওয়ার আশা
তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘সেতুটিকে ঘিরে মেঘনার বিভিন্ন চর অঞ্চলে অর্থনীনৈতিক জোন তৈরি হচ্ছে। বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় কলকারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। ফলে এসব এলাকায় যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।’
বন্দর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এ কে এম মোমিনুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতুর সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হবে এই সেতুর মাধ্যমে।
‘যাতায়াত সহজ হওয়ায় আশপাশে অনেক কলকারখানা ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। আগের তুলনায় বেড়েছে জমির দাম।’