বাংলাদেশি বংশদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ডা. রায়ান সাদী ও তার কোম্পানি ‘টেভোজেন বায়ো’ ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের ল্যান্ডিংপেজেই এ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।
ডা. সাদীর এক সময়কার সহপাঠী শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকেও বিষয়টি নিয়ে শনিবার একটি পোস্ট দেন।
বন্ধুকে অভিনন্দন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৪০ ব্যাচের বন্ধু রায়ান সাদী এমডি, এমপিএইচ, চেয়ারম্যান ও সিইও Tevogen Bio, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। আমরা গর্বিত। সাদীর প্রতি প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। সাদী ও তার পরিবারের প্রতি নিরন্তর শুভকামনা।”
পোস্টে একটি মন্তব্যে মন্ত্রী জানান, রায়ান সাদী মনোনীত হয়েছেন ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য। এই পোস্টে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রিঅ্যাক্ট করেছেন ৭ হাজার ২০০ ফেসবুক ব্যবহারকারী, শেয়ার হয়েছে ৫২৯টি।
বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর ফেসবুক পোস্ট
শান্তিতে ২০২৩ সালে নোবেলের জন্য রায়ান সাদীর ‘মনোনীত’ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা।
এতে দেখা গেছে নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার এক বছর আগে ‘সুনির্দিষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন’ ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাদের মনোনীত বা সুপারিশ করা ব্যক্তিদের নাম গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নোবেলের ছয়টি ক্যাটাগরিতে সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই নামগ্রহণ।
এরপর প্রাপ্ত নাম থেকে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির কাজ চলে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। নোবেল কমিটির পরামর্শকেরা আগস্ট মাস পর্যন্ত সেই সংক্ষিপ্ত তালিকার প্রতিটি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। সবশেষে অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় বিজয়ীর নাম।
নোবেল পুরস্কারের জন্য বিজীয় নাম চূড়ান্ত করার আগে চলে দীর্ঘ বাছাই প্রক্রিয়া
চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ৩৪৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের সুপারিশ পেয়েছিল নোবেল কমিটি। এই তালিকা থেকে চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম আগামী শুক্রবার ঘোষণা করা হবে।
ডা. রায়ান সাদী ও প্রতিষ্ঠানের নামও একই প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক সুপারিশ বা মনোনয়ন আকারে গেছে নোবেল কমিটির কাছে। ডা. সাদী ও টেভোজেন বায়োকে মনোনয়ন দিয়েছেন ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক এমেরিটাস কার্টিস প্যাটন। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানের জনস্বাস্থ্য বিভাগের মহামারি বিদ্যা (অণুজীব ঘটিত রোগ) বিশেষজ্ঞ প্যাটন একই সঙ্গে ‘টেভোজেন বায়ো’র পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক পদেও আছেন।
‘টেভোজেন বায়ো’ কোম্পানির ওয়েবসাইটের ল্যান্ডিংপেজে লেখা আছে, ‘আমরা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিই।’
এরপরেই বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে মানবতাকে জর্জরিত করে রাখা সবচেয়ে ভয়ংকর রোগগুলোর বিরুদ্ধে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য। ২০২৩ সালে শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত’।
টেভোজেন বায়ো মূলত ক্যান্সার নির্মূলের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়ে ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করে। টেভোজেন বায়োর প্রতিষ্ঠাতা ডা. রায়ান সাদী বর্তমানে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
টেভোজেন বায়োর কোম্পানির ওয়েবসাইটে রয়েছে শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত হওয়ার তথ্য
শান্তিতে নোবেলের মনোনয়ন কীভাবে
নোবেল প্রাইজের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতি বছর বছর হাজারো বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, সাবেক নোবেল বিজয়ী, পার্লেমেন্ট সদস্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিথযশা ব্যক্তিরা তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নোবেলের ছয়টি ক্যাটাগরির জন্য মনোনয়ন দিয়ে সেগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দেন।
এই মনোনয়নদাতাদের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করার উপর জোর দেয় নোবেল কমিটি। সুপারিশগুলো পাওয়ার পর নোবেল পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেন চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
এই চার প্রতিষ্ঠান হল দ্য রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস, দ্য নোবেল অ্যাসেম্বলি অ্যাট ক্যারোলিন্সকা ইন্সটিটিউট, দ্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি এবং দ্য নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি।
শান্তিতে নোবেলের জন্যও একই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন দেন সারা বিশ্বের ‘যোগ্য’ ব্যক্তিরা।
নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘নোবেল কমিটি কখনও সুপারিশ পাওয়া বা মনোনীত ব্যক্তিদের নাম সংবাদমাধ্যম, এমনকি প্রার্থীদের কাছেও প্রকাশ করে না। পুরস্কার কে পাচ্ছেন সে সম্পর্কে আগাম জল্পনা-কল্পনার মধ্যে কিছু নাম উঠে আসে। এগুলো হয় নিছক অনুমান, নয়ত মনোনয়নের সুপারিশের পিছনে থাকা ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রকাশিত।’
শুধু চলমান সময়ের নয়, মনোনয়ন ডেটাবেসের বিগত ৫০ বছরের তথ্যও গোপন রাখা হয় বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি।
ডা. সাদী ও তার কোম্পানি কীভাবে ‘মনোনীত’
ডা. রায়ান সাদী ও তার কোম্পানি টেভোজেন বায়োকে কীভাবে এবং কে মনোনয়ন দিয়েছেন সে বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে ই-মেইল পাঠায় নিউজবাংলা।
এর জবাবে টেভোজেন বায়োর পক্ষ থেকে ক্যাটলিন জয়েস লেখেন, ‘২০২৩ নোবেল শান্তি পুরস্কারের নোবেল কমিটি আমাদের বিবেচনা করায় আমরা অত্যন্ত সম্মানিত ও কৃতজ্ঞবোধ করছি।’
তিনি জানান, ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক এমেরিটাস কার্টিস প্যাটন গত সপ্তাহে এই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এবং সেটি গৃহীত হয়েছে।
টেভোজেন বায়ো কোম্পানির চেয়ারম্যান রায়ান সাদী এবং পরিচালক হিসেবে আছেন অধ্যাপক কার্টিস প্যাটন
এ বিষয়ে রায়ান সাদীর একটি বিবৃতিও ই-মেইলে তুলে ধরেন ক্যাটলিন জয়েস। এই বিবৃতিতে সাদী বলেন, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য টেভোজেন বায়োর মনোনয়ের খবরে আমরা সম্মানিত ও কৃতজ্ঞবোধ করছি। এই অর্জনটি আমাদের পরিচালনা নীতিকে আরও বেগবান করবে। এই নীতিটি হলো সামাজিক সমৃদ্ধি, জনগণের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল এবং সর্বোপরি মানব জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে না পারলে টেকসই ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন অসম্ভব।’
নোবেল কমিটির তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্ব থেকে পাওয়া নাম থেকে ফেব্রুয়ারিতে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির কাজ শুরু হবে। এছাড়া মনোনীতদের বিষয়ে নোবেল কমিটি কখনোই তথ্য প্রকাশ করে না। এরপরেও ডা. রায়ান সাদী ও তার কোম্পানি টেভোজেন বায়োকে কীভাবে ২০২৩ সালের শান্তি পুরস্কারের জন্য ‘মনোনীত’ বলা যাবে- সেই প্রশ্ন রেখে মনোনয়নদাতা অধ্যাপক কার্টিস প্যাটনকেও ই-মেইল করেছে নিউজবাংলা।
তবে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত সেই ই-মেইলের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
শান্তিতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ নোবেল কতবার
১৯০১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ২৫টি প্রতিষ্ঠান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। এর মধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ইউএনএইচসিআর) দুবার এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেডক্রস তিনবার এই পুরস্কার জয় করে। এর অর্থ হলো, সব মিলিয়ে ২৮ বার নোবেল শান্তি পুরস্কার গেছে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে।
কোনো কোনো বছর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল জয় করেছেন। যেমন ২০০৬ সালে এই পুরস্কার যৌথভাবে পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক।
ড. ইউনূস ছাড়াও আরও কয়েকজন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পান। ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান অ্যালবার্ট আর্নল্ড (আল) গোর জুনিয়র ও ইন্টারগভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)।
এর দুই বছর আগে শান্তিতে ২০০৫ সালে নোবেল জয় করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি ও এর প্রধান মোহামেদ এলবারাদি। ২০০১ সালে যৌথভাবে পুরস্কার পায় জাতিসংঘ এবং এর তখনকার মহাসচিব কফি আনান।
এর আগে ল্যান্ডমাইনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৭ সালে যৌথভাবে এই পুরস্কার পান জোডি উইলিয়ামস ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু ব্যান ল্যান্ডমাইনস (আইসিবিএল)’। এছাড়া, ১৯৯৫ সালে জোসেফ রটব্লাট ও পগওয়াশ কনফারেন্সেস অন সায়েন্স অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল জয় করে।
এর আগে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কোনো ব্যক্তি শান্তিতে নোবেল পাননি। তবে যৌথভাবে দুটি প্রতিষ্ঠানের নোবেল জয়ের নজির রয়েছে। এটি প্রথম দেয়া হয় ১৯৪৭ সালে। সেবার ফ্রেন্ডস সার্ভিস কাউন্সিল এবং আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি যৌথভাবে নোবেল পায়।