দেশে নিষিদ্ধঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেতা ও সদস্যদের নিয়ে ২০১৭ সালে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানিয়েছে র্যাব।
বাহিনীর ভাষ্য, ২০১৯ সালে এ সংগঠনের নাম দেয়া হয় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ বা পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার।
র্যাব জানায়, কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার করতে গিয়ে এই সংগঠনের তথ্য পাওয়া যায়।
বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চারজনসহ সাতজনকে বুধবার মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অন্য জঙ্গি সংগঠনের মতো তারাও ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন।
তারা হলেন পটুয়াখালীর হোসাইন আহম্মদ, নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের, বনি আমিন। বাকিরা হলেন ঘর ছেড়ে যাওয়া কুমিল্লার তরুণ ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত, মো. হাসিবুল ইসলাম, গোপালগঞ্জের রোমান শিকদার ও পটুয়াখালীর মো. সাবিত।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বৃহস্পতিবার ব্রিফিংয়ে জানান, গ্রেপ্তার হোসাইন আহম্মদ পটুয়াখালীর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, নিষিদ্ধঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কিছু সদস্য একত্রিত হয়ে ২০১৭ সালে নব্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সালে সংগঠনটি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নাম ধারণ করে।
তিনি জানান, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মীরা একত্রিত হয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। হোসাইন সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে সিরাজ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেপ্তার নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের ভোলায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরতকৃত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ৯ থেকে ১০ সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
র্যাবের কর্মকর্তা আল মঈন জানান, গ্রেপ্তার বনি আমিন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস ও সার্ভিসের ব্যবসা করতেন। তিনি সদস্যদের আশ্রয় দেয়া ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন। ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ২২ থেকে ২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি তাদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বনি।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার রিফাত কুমিল্লায় অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। গ্রেপ্তার হাসিব উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত এবং একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হতে গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার রোমান পুরপ্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক্যাল ও স্যানিটারিবিষয়ক কাজ করতেন। তিনি অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা পায়। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়।
গ্র্রেপ্তার সাবিত উত্তরা এলাকায় প্রায় এক মাস আগে একটি ছাপাখানায় স্টোর কিপারের কাজ করতেন। তিনি তার এক আত্মীয় ও অনলাইনে ভিডিও দেখার মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। তিনি জুন মাসে নিখোঁজ হন।
নতুন এই সংগঠনের আমির কে এবং সদস্য সংখ্যা কত, সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত সংগঠনটির আঞ্চলিক নেতা পর্যন্ত আটক করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা তার কাছ থেকে শুধু সংগঠনটির নাম জানতে পেরেছি। সঙ্গে এটাও জানা গেছে, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো যেমন হুজি, জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এসব সংগঠন থেকে লোকজন চলে এসে এই নতুন সংগঠনটি গড়ে তুলেছে। ২০১৭ সালে তারা একসঙ্গে কার্যক্রম শুরু করে এবং ২০১৯ সালে সংগঠনের নামকরণ করে।
‘এখন পর্যন্ত সংগঠনটির আপার টিয়ার অর্থাৎ তাদের শুরা সদস্য কতজন বা তাদের আমির কে এ বিষয়ে জানতে আমাদের তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ চলমান আছে।’
তাদের কোনো হামলার নির্দেশনা ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের স্টেপ বাই স্টেপ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা একটি স্টেপ যখন উত্তীর্ণ হয়েছে, এরপর তাদের অন্য স্টেপে পাঠানো হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাদের ভেতরে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্রোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা যাদের আটক করেছি, তাদের প্রশিক্ষণের পর সশস্ত্র সংগ্রামে যেতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল।
‘তাদের ভোলা ও পটুয়াখালীর চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে আরও কঠিন প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এমনটা বলা হয়েছিল, তবে তাদের কোথায় কীভাবে সংগ্রাম করতে হবে এমন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া লিফলেটগুলো দেখলে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে ক্রোধ সৃষ্টি করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য ও বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাই এই দুই বিভাগ তাদের টার্গেট হতে পারে।’
চরাঞ্চলে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘তাদের প্রথমে জিহাদি বইয়ের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং সংগঠনের নিয়ম-কানুন শেখানো হয়েছে। এরপর ফিজ্যিক্যাল কিছু কসরত শেখানোর মাধ্যমে কীভাবে ফিট থাকতে হয় তা শেখানো হয়েছে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বেশে আত্মগোপনে থাকার কায়দাকানুন শেখানো হয়েছে।’