দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)। এ অঞ্চলের বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুৎ সেবা নিলেও এ কোম্পানির বিল নিয়মিত পরিশোধ করছে না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও বকেয়া আদায় হয়েছে খুবই সামান্য।
ওজোপাডিকো সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সরকারি ৩১টি দপ্তরের কাছে তাদের বকেয়া ১৮৮ কোটি ৮৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৭ টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন ৩৫টি পৌরসভার কাছে বকেয়া রয়েছে ৭৬ কোটি ৯ লাখ ৭ হাজার ৭৪০ টাকা। খুলনা সিটি করপোরেশনের কাছে বকেয়া ২৫ কোটি ৮৬ লাখ ১৬ হাজার ২৬৪ টাকা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাছে বকেয়া ৫০ কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৬ টাকা।
ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম জানান, ১ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন নোটিশ দেওয়ার পরও বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করলে গ্রাহকের সংযোগ কেটে দেওয়ার। সেই মোতাবেক মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সব বিতরণ সংস্থাকে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ওজোপাডিকোর অধীন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া পরিশোধ করার জন্য গত ৭ সেপ্টেম্বর তাদের নোটিশ করা হয়েছিল। তাদের জানানো হয়েছিল ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। নোটিশের পরও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ বা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এমন ৭৫টি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি বিদ্যুৎ সংযোগের বিপরীতে মাত্র ৩ কোটি ৩৪ লাখ ২১ হাজার ৮৯৯ টাকা বকেয়া আদায় হয়েছে।’
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো নিজেদের অফিসের বিল নিয়মিত পরিশোধ করে আসছে। তবে জনবান্ধব সেবা যেমন: রাস্তার লাইট ও পানির পাম্পের বিল বছরের পর বছর ধরে পরিশোধ করে না। প্রায় ক্ষেত্রে আমরা উত্তর পাই, দিয়ে দিব। তবে তারা কবে দেবেন সেই উত্তর পাই না।’
ওজোপাডিকোর হিসাবে দেখা গেছে, জনসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সব থেকে বেশি বকেয়া বিল রয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের। এ ছাড়া ১ কোটি টাকার ওপরে বকেয়া রয়েছে ১৬টি পৌরসভার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহম্মদ বলেন, ‘ওজোপাডিকো যে হিসাব দিয়েছে, তার মধ্যে কিছু বিল আছে, যা আমাদের না। এটা নিয়ে তাদের কয়েকবার বলা হয়েছে, আপনারা বসেন। একসঙ্গে বসে আমরা সমন্বয় করি। কিছু কিছু করে আমরা বকেয়া দিয়ে দিব।’
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র আলী আকবর টিপু বলেন, ‘আমরা এই বিল পরিশোধ করে দিব। করোনার ১৭ মাস আমাদের একটা সংকট তৈরি হয়েছিল। আমরা এটা ওভারকাম করে ফেলব খুব দ্রুত।’
যশোর পৌরসভার মেয়র মো. হায়দার গণি খান পলাশ বলেন, ‘এই বকেয়াটা এক-দুই বছরের না। পূর্বে সময়ের মেয়ররাও বকেয়া রেখেছেন। তা এখন আমাদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।’
বাগেরহাট পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাবেরুল ইসলাম বলেন, ‘পৌরসভার রাজস্ব তহবিলে ঘটতি আছে, তাই বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে একটু দেরি হচ্ছে।’
ওজোপাডিকো সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে জুন পর্যন্ত তাদের মোট গ্রাহক ছিল ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯১ জন। এর মধ্যে প্রি-পেইড গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৬।
বিদ্যুৎ আইনে বলা হয়েছে, তিন মাস ধরে যদি কোনো গ্রাহক বকেয়া পরিশোধ না করে, তবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। ব্যক্তিগত গ্রাহক পর্যায়ে এই আইন প্রয়োগে কঠোর রয়েছে ওজোপাডিকো। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেলায় তা সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। এতে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
ক্যাবের খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম ডেভিড বলেন, ‘ওজোপাডিকো ৪ লাখের বেশি সাধারণ গ্রাহকের জন্য প্রি-পেইড মিটার বসিয়েছে। অগ্রিম টাকা দেয়া ছাড়া তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। সাধারণ গ্রাহকরা সঠিক সেবাও পাচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে বিল পরিশোধ করছে না। এটা এক দেশে বিদ্যুতের দুই নীতি হয়ে যায়।’