আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সশস্ত্র মুখোমুখিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির ঘটনার রেশ ধরেই এই মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা ঘটে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলির ঘটনাও ঘটেছে।
ক্যাম্পাসে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার এক জরুরি সভা শেষে আগামী ১০ থেকে ১৭ অক্টোবরের সব পরীক্ষা স্থগিত করে দেয় প্রশাসন। সেই সঙ্গে রোববার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই ছাত্রদের এবং সোমবার সকাল ৯টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত হলগুলো বন্ধ থাকবে।
কেন এই অচলাবস্থা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে গত কয়েক দিনে বেশ কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। তারা বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এমন অস্থিরতা নিয়ে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ যেকোনো সময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কমিটি দিতে পারেন, এমন খবর চাউর হয়েছে। খবর চাউরের পরই নিজেদের আধিপত্য জানান দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মনোযোগে আসতে চেষ্টা শুরু করেছেন ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ।
ক্যাম্পাসে সশস্ত্র মহড়া দেয়ার অভিযোগ উঠেছে হত্যা মামলার আসামি ও ছাত্রত্ব নেই এমন পদপ্রত্যাশীদের। তাদের উদ্দেশ্য, যে করেই হোক আগামী কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেয়া।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, প্রতিপক্ষের কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়ার। কখনো প্রতিপক্ষের অনুসারীদের ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে মারধর করারও।
এসব অভিযোগ হত্যা মামলার আসামি বিপ্লব চন্দ্র দাস ও রেজা ই এলাহীর বিরুদ্ধে।
তাদের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং হল বন্ধ করে দেয়ার পরিস্থিতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কমপক্ষে ২০ শিক্ষার্থী।
২০১৬ সালের ১ আগস্টের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো নিয়ে নিহত হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ।
ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি হত্যা মামলা করে। সে মামলায় ৫ দিন পর ৬ আগস্ট প্রধান আসামি ও মার্কেটিং চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী বিপ্লব চন্দ্র দাসকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। বিপ্লব হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তবে তিনি এখন জামিনে মুক্ত।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জামিনে বেরিয়ে বিপ্লব আরও বেপরোয়া হয়েছেন। গত শনিবার মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দেন বিপ্লবের অনুসারীরা, ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুলিশের সামনে তাদের দেখা যায়।
বিপ্লবকে সমর্থন দিচ্ছেন কুবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা ই এলাহী। তিনি নিজেও কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার আসামি।
তার বিরুদ্ধে অটোরিকশাচালকসহ বহিরাগতদের নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের সংঘর্ষ বাধতে পারে।
কী বলছেন গুলিতে নিহতের পরিবার
কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহর মা ফাতেমা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, ৬ বছরেও তার সন্তান হত্যার বিচার পাননি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের খুনিরা এখন ছাত্রলীগের পদ-পদবি চায়। এই বিপ্লব ও রেজা আমার ছেলের খুনের মামলার আসামি। বিপ্লব খুনের ঘটনা স্বীকারও করেছে। তারপরও কেন তাদের বিচার হচ্ছে না?’
তিনি আশঙ্কা করেন, আবারও তারা হত্যার রাজনীতি করবেন। তাই তাদের যেন কোনো পদ-পদবি না দেয়া হয়, সে জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের অনুরোধ করেন সাইফুল্লাহর মা ফাতেমা আক্তার।
যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ছাত্রলীগের সভাপতি রাফিউল আলম দীপ্ত বলেন, ‘সেদিন আমরা দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে হলে ঘুমাচ্ছিলাম। এ সময় আচমকা বহিরাগতরা এসে ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি ছোড়ে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো বিকার দেখলাম না। ঘটনায় যারা জড়িত সবাই বিশ্ববদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অটো ও সিএনজি অটোরিকশার চালকদেরও দেখা যায়। যারা টাকার বিনিময়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।’
কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশেরও একই প্রশ্ন, প্রধান ফটকে তালা মারা অবস্থায় বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশের সামনে দিয়ে অস্ত্র হাতে কীভাবে ককটেল বিস্ফোরণ করল, গুলি ছুড়ল।
তিনি এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ব্যর্থতা রয়েছে বলে জানান।
একই প্রশ্ন তুলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক খায়রুল বাশার সাকিবও। তার আশা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন ঘটনার সমাধান করবে। বহিরাগতদের প্রবেশ রুখে দেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক বন্ধই থাকে। কিন্তু শনিবার বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফটক খুলে দেয়া হয়। তারা ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবার তা খুলে দেয়া হয়।
কারা এভাবে ফটক খুলে বহিরাগতদের অস্ত্রের মহড়া দিতে দিয়েছে, সেটি জানে না প্রশাসন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকীকে বেশ কয়েকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, সেদিন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ছিল।
‘আমরা প্রথমে চিন্তা করেছি আমার কোনো শিক্ষার্থী যেন খুন না হয়, কোনো রক্তপাতের ঘটনা যেন না ঘটে। সে লক্ষ্যেই দ্রুত হল বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ করেছি। এতে করে কেউ যদি আমাদের দোষারোপ করে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা রয়েছে- এমন প্রশ্নে ভিসি আবদুল মঈন বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হোক আর ক্লাস সবাইকে তাদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানো হবে। আমরা সিদ্ধান্তে অটল।’
অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী দাবি করেন, পুলিশ যদি অনড় থাকে এবং অস্ত্র উদ্ধার করে তাহলে ক্যাম্পাসে কেউ হট্টগোল করে বের হয়ে যেতে পারবে না।
বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সম্ভব সব রকম কাজ করব। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় করতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে।’