জাতীয় প্রেস ক্লাবে শেষবারের মতো নেয়ার পর তোয়াব খানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনীতিকরা। তারা এই প্রথিতযশা সাংবাদিকের অতীতের নাান কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে বলেছেন, চিন্তায়, কর্মে শুদ্ধ, সৎ একজন মানুষ, সক্রিয় একজন সংবাদকর্মীকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এটি দেশের সাংবাদিকতা জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
তোয়াব খান যে সাহস-সততা আর কর্মনিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন, সেটি বর্তমান আর ভবিষ্যতের সাংবাদিকরা অনুসরণ করে সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তারা।
সোমবার বেলা একটায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের টেনিস কোটে নেয়া হয় নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম ও দৈনিক বাংলার সম্পাদক একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক তোয়াব খানকে।
সেখানে জানাজার আগে ও পরে প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্টজনেরা, করেন স্মৃতিচারণ। সবার মুখেই একই কথা, ‘তোয়াব খানকে কখনও ভোলা যাবে না।’
জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তোয়াব খানকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ বিশিষ্টজনরা। ছবি: নিউজবাংলাজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক কামরুল ইসলাম খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক।
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এহসানুল করিম, ডেপুটি প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষারও তোয়াব খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
দৈনিক কালের কণ্ঠ, ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি, নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ফোরাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকেও জানানো হয় শ্রদ্ধা।
বার্ধক্যজনিত জটিলতায় অসুস্থতার পর তোয়াব খানকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত শনিবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
সোমবার সকালে তেজগাঁওয়ের দৈনিক বাংলা ও নিউজবাংলা কার্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম জানাজা শেষে প্রথিতযশা সাংবাদিককে নেয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে। সেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। এরপর মরদেহ নেয়া হয় প্রেসক্লাব।
জানাজার আগে কৃতি এই সাংবাদিকের স্মরণে জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমরা শোকে ভারাক্রান্ত, জাতীয় প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য তোয়াব খান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মনে হয়, প্রকৃতিও কাঁদছে যে আমরা তোয়াব খানকে শেষ বিদায় দিচ্ছি।
‘আমরা কোনোদিন তাকে ভুলব না। তোয়াব খানের সঙ্গে দেশের সাংবাদিকতার একটি ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হচ্ছে।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘তিনি একজন বিরল সাংবাদিক। তাকে আমি দেখেছি ষাটের দশকের শুরু থেকে ১৯৭০ সালে ওনার সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন তিনি দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক। তখন আমি একতার সাংবাদিক। ওনি একটা বামপন্থি পরিবার, বামপন্থি পরিধি, পুরো জীবনই একটা বামপন্থি চিন্তা ধারার মধ্য দিয়ে কেটেছে। তিনি বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘সাংবাদিক হিসেবে, সংবাদ কর্মী হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে এবং কখনও কখনও সরকারি উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে সব সময় তার সঙ্গে দেখা, কথা বলার সুযোগ হয়েছে।
‘তিনি আজীবন একজন সক্রিয় সাংবাদিক, চিন্তায়, মননে আবার আজীবন পাশাপাশি একজন বামপন্থার চিন্তাধারার সমর্থক হিসেবে সক্রিয়তার সঙ্গে তিনি বেঁচে ছিলেন। তার স্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম, শুভেচ্ছা এবং তিনি তার কর্মের মধ্যে বেঁচে ছিলেন, কর্মের মধ্যেই থাকবেন। তাকে আমরা সব সময় স্মরণ করি। তিনি একজন অতি সক্রিয় উদ্যোগী সাংবাদিক, সম্পাদক এবং একনিষ্ঠ শুভাধ্যায়ী ছিলেন। তার প্রতি আমাদের সকল শুভেচ্ছা, সকল কৃতজ্ঞতা।’
জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তোয়াব খানকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ বিশিষ্টজনরা। ছবি: নিউজবাংলাতথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জনাব তোয়াব খান বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি ছিলেন। তিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসী অবদান রেখেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি পিআইবির মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।
‘দৈনিক পাকিস্তান যখন নাম পরিবর্তন করে দৈনিক বাংলা, সেটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন জনাব তোয়াব খান। আজকে তিনি দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক থাকা অবস্থায় তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। তার হাত ধরে বহু প্রথিতযশা সাংবাদিকের জন্ম হয়েছে। তার লেখনি আমাদের দেশ-জাতিকে উপকৃত করেছে। তিনি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একজন পথিকৃত। তার এই মৃত্যু আমাদের সাংবাদিকতা জগতের জন্য শুধু নয়, আমাদের পুরো জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
মন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করতে গিয়ে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন। আরও অনেক সাংবাদিক যারা রক্তচক্ষুর মধ্যেও অন্যায়ের কাছে যারা মাথা নত করেনি, তাদের পুরোধা ছিলেন জনাব তোয়াব খান। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, আমি মনে করি আজকের সাংবাদিকদের জন্য তা উদাহরণ হিসেবে সব সময় থাকবে।’
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘তিনি (তোয়াব খান) বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এবং সাহসী সাংবাদিকতার প্রতীক হিসেবে ছিলেন। তার প্রয়াণে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।
‘আমি আশা করি তিনি সাংবাদিকতায় যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তিনি যে সাহস নিয়ে এই পেশার চর্চা করেছেন, তিনি যে দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেছেন, নিশ্চয় আজকে যারা সাংবাদিকতা পেশায় আছেন, যারা নতুন আসছেন, যারা আগামীতে আসবেন, তারা নিশ্চয় তার সেই আদর্শকে তার সেই পথকে অনুসরণ করবেন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম তো আমাদেরকে পথ দেখায়। আমাদের ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেয়। আমাদেরকে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়। কাজেই সেখানে বস্তুনিষ্ঠতা ভীষণ জরুরি। তার মতো একজন মানুষের চলে যাওয়া নিশ্চয় অপূরণীয় ক্ষতি। আমি আশা করি, আমরা তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কিছু করব এবং তার বস্তুনিষ্ঠতা, তার যে সাহস, তার যে প্রত্যয়, তার যে দেশপ্রেম, সেটাকে ধরে রাখব এবং আমরা আমাদের সকলের কাজের ক্ষেত্রে সেই একই চর্চা আমরা করার চেষ্টা করব।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক তোয়াব খানের জানাজা। ছবি: নিউজবাংলাএ সময় জানানো হয় তোয়াব খান ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজউদ্দিন স্মরণে আগামী ৮ অক্টোবর সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সভা হবে জানিয়ে সবাইকে তাতে যোগ দেয়ার অনুরোধও করেন সাংবাদিকদের সংগঠনটির সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন।