দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা ভর করেছে। বাড়ছে অস্থিতিশীলতা, সংঘাত-সহিংসতা। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়, এই অস্থিতিশীলতা রয়েছে কয়েকটি দলের ভেতরও। জোট রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে অস্থিরতা।
দলে ও রাজনীতির মাঠে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই এসব অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা সংঘর্ষে জড়িয়েছে। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কথার লড়াই চলছে আগে থেকেই।
আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টিতে চলছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বড় নেতার ছোট দল গণফোরামে চলছে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার। শাসক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে চলছে টানাপড়েন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়া নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ আলোচনা এসেছে প্রকাশ্যে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সন্দেহ, সংশয় আর অবিশ্বাস।
বরিশাল নগরীতে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে জাতীয় পার্টির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। ফাইল ছবি
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুখকর নয়। প্রধান দুই দলের মধ্যে রাজপথ দখলের লড়াই শুরু হয়েছে। অন্য দলগুলোও নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি দেশ ও জনগণের জন্য সুখকর নয়।
‘রাজনীতির ময়দানে যেমন দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া দরকার, তেমনই নিজেদের মধ্যেও বোঝাপড়া হওয়া দরকার। তাহলেই দেশ ও জনগণের কল্যাণ হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী মনে করছেন, রাজনীতি ব্যক্তি-স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে ওঠায় এসব সংঘাত-সহিংসতা।
তিনি বলেন, ‘এ দেশের রাজনীতিবিদরা সামষ্টিক স্বার্থে রাজনীতি করেন না, করেন ব্যক্তিস্বার্থে। কিছু পেতে হবে- এমন মনোভাব থেকেই তারা দলে ও রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।’
মুন্সীগঞ্জে ২৬ আগস্ট বিএনপির কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার পর সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিএনপি কর্মীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। ফাইল ছবি
সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রধান খবর হয়ে উঠছে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ। সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর মিরপুরে সংঘর্ষে জড়ায় দল দুটির নেতা-কর্মীরা। এভাবে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, মাগুরা, বরিশালের গৌরনদী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দল দুটির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর লালবাগে ও ২৩ সেপ্টেম্বর চকবাজারে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আবার ১৮ সেপ্টেম্বর বরিশালে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের খানসামায়, ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামে, ২৪ আগস্ট মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতও তত প্রকট হয়ে উঠছে। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি কার্যত তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই দলটির চেয়ারম্যান হন। পাশাপাশি আরও দুটি পক্ষ দলটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা তার ছেলে এরিক এরশাদকে দিয়ে দলটির নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন দলের ছোট্ট একটি অংশ নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন।
এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ সম্প্রতি দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে পাশ কাটিয়ে দলের সম্মেলন ডাকেন। এর মধ্য দিয়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা ও উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
চলতি বছরের ১২ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণফোরামের একাংশের কর্মসূচিতে অপর অংশের কর্মী-সমর্থকরা হামলা চালায়। ফাইল ছবি
আরেক রাজনৈতিক দল গণফোরামে চলছে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন বহিষ্কার করেন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ও তার অনুসারীদের। পাল্টা হিসেবে মোস্তফা মহসিন মন্টু পৃথক সম্মেলন করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন এবং ড. কামালকে অব্যাহতি দেন।
দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধের পাশাপাশি জোট রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে অস্থিরতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে চলছে টানাপড়েন।
মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের নিউজবাংলা বলেন, ‘এই জোটের আর অস্তিত্ব নেই।’
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সাম্প্রতিক সময়ে জোটের বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। আরেক জোট ১৪ দলের তিন শরিক দল দ্রব্যমূল্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ইস্যুতে সরাসরি সরকারের সমালোচনা করছে।
ভাঙনের শব্দ আছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেও। ২০ দলে জামায়াত নেই- দলটির আমির ডা. শফিকুল ইসলামের এমন বক্তব্য ২৮ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তিনি এ বক্তব্য দেন দলটির অভ্যন্তরীণ এক বৈঠকে। এরপর বিএনপি বা জামায়াত কোনো দলই বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। যদিও পরে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন ও শামসুজ্জামান দুদু একাধিক বক্তব্যে জামায়াতের সমালোচনা করেন।
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হারুনুর রশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে অনেক রাজনৈতিক দলেই ভাঙাগড়া হয়। নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলো নিজেদের সাজাতে চায়, আবার একাধিক সক্রিয় পক্ষ দলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। সে কারণেই মূলত অস্থিরতা শুরু হয়। একইভাবে জোট রাজনীতিতেও সুবিধাপ্রাপ্তি ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ থেকে যোগ-বিয়োগ চলে।’