দুর্ধর্ষ চোর ইসমাইল খানের পরিচিতি ব্ল্যাক স্পাইডার নামে। এমন নাম হওয়ার বিশেষত্বও আছে। তিনি ভবনের পানি ও স্যুয়ারেজ লাইনের পাইপ ও গ্রিল বেয়ে বহুতল ভবনের চূড়া পর্যন্ত উঠে যেতে পারেন। এভাবে টার্গেট করা বাসা বা ফ্ল্যাটে উঠে গ্রিল কেটে ঢুকে যান ভেতরে। পরে সহযোগীদের নিয়ে টাকাপয়সা, স্বর্ণালঙ্কার ও মালামাল চুরি করে নির্বিঘ্নে কেটে পড়েন।
তবে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছেন এই ব্ল্যাক স্পাইডার। কেরানীগঞ্জের কূলচর এলাকা থেকে বুধবার তাকে পাকড়াও করেছে রাজধানীর হাতিরঝিল থানা পুলিশ। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই সহযোগী ফাহাদ হোসেন কামাল ও আরিফ হোসেনকে।
একইসঙ্গে আটক করা হয়েছে গোপাল ঘোষ নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে। ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে আটক হওয়া এই ব্যক্তি চোরাই স্বর্ণালঙ্কারের ক্রেতা বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে একটি ভবনের সপ্তম তলায় সপরিবারে থাকেন তৌহিদুল ইসলাম। ৩০ এপ্রিল ঈদের ছুটিতে সপরিবারে তিনি গ্রামের বাড়িতে যান। পাঁচদিন পর তার স্ত্রী ঢাকায় ফিরে বাসার দরজা খুলে দেখেন সব জিনিস এলোমেলো। তিনটি আলমারির তালা খোলা এবং রান্নাঘরের পাশের জানালার গ্রিল কাটা। আলমারিতে রাখা টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় সাড়ে বারো লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়ে গেছে।
এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মামলা হলে তদন্তে নামে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে একটি সিসি ক্যামেরার অস্পষ্ট ফুটেজে মাস্ক ও ক্যাপ পরা একজনকে ব্যাগ হাতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠে চলে যেতে দেখা যায়। এই ফুটেজ ও অন্যান্য প্রযুক্তির সহায়তায় ইসমাইল খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে নিউ ইস্কাটনের বাসা থেকে চুরি হওয়া বিদেশি ব্র্যান্ডের দুটি ঘড়িসহ স্বর্ণ ও হীরা যাচাই করার যন্ত্র, স্বর্ণ পরিমাপের যন্ত্র, ক্যামেরা, চোরাই মোবাইল, ৩ কেজি ওজনের বিদেশি ধাতব মুদ্রা, বিদেশি মুদ্রা ও অত্যাধুনিক গ্রিল কাটার মেশিন জব্দ করা হয়।
উপ-কমিশনার আজিমুল হক বলেন, ইসমাইলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফাহাদ হোসেন কমলকে ঢাকার রূপনগর এলাকা থেকে এবং আরিফ হোসেনকে কাফরুল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে চোরাই মোবাইল ফোন, হাতঘড়ি, বিদেশি মুদ্রা, ক্ষুদ্রাকৃতির টর্চলাইট, চুরির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং স্বর্ণ মাপার যন্ত্র জব্দ করা হয়।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের তথ্যের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত তিনজন গোপাল ঘোষের কাছে শতাধিকবার চোরাই স্বর্ণ বিক্রি করেছে বলে স্বীকার করেছে।
গ্রেপ্তারকৃত তিন চোর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল এলাকায় গ্রিল কাটা ও বাসার দরজার তালা ভেঙে চুরির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এই চক্রে আরও ২০ জন রয়েছে।
২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত চক্রটি ঢাকার মিরপুর, কলাবাগান, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও ও লালবাগ এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশালে পাঁচ শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত।
আজিমুল হক বলেন, ‘ইসমাইল পানি ও স্যুয়ারেজের পাইপ এবং গ্রিল বেয়ে উঠে বহুতল ভবনের টার্গেট বাসা/ফ্ল্যাটে গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে চুরি করে। আরিফ দরজার তালা ভাঙার কাজে দক্ষ। আর ফাহাদ চুরির স্পট থেকে সামান্য দূরে মোটরসাইকেল নিয়ে চুরির পর নিরাপদ প্রস্থানের জন্য অপেক্ষা করে। পাশাপাশি পুলিশের গতিবিধি খেয়াল রাখে।’
তিনি বলেন, ‘এই চক্রের অন্য ২০ সদস্য মূলত বিভিন্ন এলাকার চুরি করার মতো সম্ভাব্য বাসা/ ফ্ল্যাট সম্পর্কে তথ্য দেয়। তারা চুরির সময় স্পটে থাকে না। গ্রেপ্তার তিনজন পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে চুরি করে। পরে তারা টার্গেট জানিয়ে দেয়া সদস্যদের বিকাশ, রকেট ও নগদ একাউন্টে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে দেয়।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই চক্র ঢাকাসহ যেসব এলাকায় চুরি করেছে, সেই স্থানগুলো আইডেনটিফাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এই চক্রের অবশিষ্ট ২০ সদস্যকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার ইসমাইলের বিরুদ্ধে ৪টি, আরিফের বিরুদ্ধে ২টি ও ফাহাদের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা পাওয়া গেছে।