কক্সবাজারে শরণার্থী ক্যাম্পে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস্ (এআরএসপিএইচ) এর প্রধান মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহর পরিবারের ২৫ সদস্য এখন কানাডায়। এতে মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, পরিবারের যারা কানাডায় চলে গেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই এ মামলার সাক্ষী।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি মো. ফরিদুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে বিদেশ পাড়ি দেয়ায় মামলাটির বিচার কাজে স্থবিরতা আসবে। কারণ, চলে যাওয়াদের অনেকে এ মামলার সাক্ষী বা প্রত্যক্ষদর্শী। আইনি ভাষায় সাক্ষী ছাড়া বিচারিক কাজ আগানো কঠিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলাটি যদি সাক্ষীর পর্যায়ে আসে, তাহলে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাইব। যাতে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাক্ষ্য নেয়া হতে পারে।’
আইনজীবী আয়াছুর রহমান বলছেন, ‘মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। আদালত চার্জ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখের পথে রয়েছে। কিন্তু তার মাঝেই সাক্ষীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এ মুহূর্তে আসলে মামলার বিচারিক অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।’
গেল রোববার ঢাকার উদ্দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়েন মুহিবুল্লার পরিবারের ১৪ সদস্য। সেদিন সকালে উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলেও বিষয়টি অত্যন্ত গোপন রাখা হয়। বিষয়টি জানাজানি হয় পরদিন সোমবার। এর আগে গত ৩১ মার্চ মুহিবুল্লাহর স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের ১১ জন সদস্যকে কানাডা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ এর সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তত্ত্বাবধানে মুহিবুল্লাহর পরিবারের ১৪ সদস্যকে তাদের ব্যাটালিয়নের অধীনে ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে ঢাকায় নেয়া হয়েছে।’
এপিবিএন জানিয়েছে, সোমবার গভীর রাতে কানাডায় পাড়ি দেয়া পরিবারের ১৪ সদস্যের মধ্যে ছিলেন মুহিবুল্লাহর মা উম্মে ফজল, ছোট ভাই হাবিব উল্লাহর স্ত্রী আসমা বিবি, সন্তান কয়কবা, বয়সা, হুনাইসা, মো. আইমন, ওরদা বিবি, মো. আশরাফ ও আরেক ভাই আহমদ উল্লাহর স্ত্রী শামছুন নাহার, সন্তান হামদাল্লাহ, হান্নানা বিবি, আফসার উদ্দীন, সোহানা বিবি ও মেজবাহ উল্লাহ। প্রথম দফায় গিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খাতুন, ৯ ছেলে-মেয়ে, জামাতাসহ ১১।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তত্ত্বাবধানে তারা কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।
ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার সময় সেখানে পুলিশসহ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) এবং ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সবশেষ রোহিঙ্গা নির্বাসনের দুই বছর পর্যবেক্ষণ উপলক্ষে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা সদস্য নিয়ে সমাবেশ করার পর নেতা হিসেবে লাইমলাইটে আসেন মুহিবুল্লাহ।
মুহিবুল্লাহ ২০০০ সালের শুরুতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানরাইটস’ নামের সংগঠন, যা এআরএসপিএইচ নামে বেশি পরিচিত। অন্যদেশের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গেও গড়ে তোলেন গভীর যোগাযোগ। ধীরে ধীরে মুহিবুল্লাহ হয়ে ওঠেন প্রধান পাঁচ রোহিঙ্গা নেতার একজন।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ ব্লকে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন তিনি। মিয়ানমারের মংডুতে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন বলে রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মুহিবুল্লাহ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
পরদিন তার ভাই হাবিব উল্লাহর অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ। ২০২১ সালের অক্টোবরে, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৪) সদস্যরা মহিবুল্লাহ হত্যাকারী দলের সদস্যসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে।
এদের মধ্যে আসামি আজিজুল হক পরদিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বাকি ৩ আসামিরা হলেন- কুতুপালং ক্যাম্পের ডি-ব্লকের মুহাম্মদ রশিদ ওরফে মুর্শিদ আমিন, ক্যাম্পের বি-ব্লকের মুহাম্মদ আনাস ও নুর মুহাম্মদ।
সেসময় মুহিবুল্লাহর পরিবার দাবি করেছিল, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় থাকায় এবং শিবিরে জনপ্রিয় হয়ে উঠার কারণে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর থেকে মুহিবুল্লাহর পরিবার নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে আসছিল। এ জন্য বিদেশে আশ্রয় চেয়ে তারা দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে আবেদন করেছিলেন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৯ আসামির বিচার শুরু হয়। জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বর্তমানে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।