খুলনার মহেশ্বরপাশার বাড়ি থেকে অপহরণ হয়েছিলেন বলে দাবি করলেও ঘটনার পর বান্দরবানের একটি ভাতের হোটেলে গিয়ে কাজ চেয়েছিলেন মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম। এ তথ্য জানিয়েছে খুলনার পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
নিউজবাংলাকে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানিয়েছেন, উদ্ধারের পর পুলিশকে দেয়া তথ্যের সঙ্গে আদালতে রহিমার দেয়া জবানবন্দিতে আছে বেশ কিছু গরমিল। এ কারণে ঘটনাটি অপহরণ নয় বলে অনেকটাই নিশ্চিত তিনি।
মাকে খুঁজে পেতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, সংবাদমাধ্যমে নানা সাক্ষাৎকার ও ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় মরিয়ম মান্নান। মায়ের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে বরাবরই তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমির বিরোধের বিষয়টিকে দায়ী করে আসছিলেন। গত ২৭ আগস্ট রাতে রহিমা নিখোঁজ হন। ফরিদপুরের বোয়ালমারীর একটি গ্রাম থেকে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় উদ্ধার করা হয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে।
এসপি মুশফিকুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রহিমা বেগম আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেই তথ্য আমরা ক্রস ম্যাচিং করে দেখেছি। ইতোমধ্যে তাকে অপহরণের বিষয়টি আমাদের কাছে ভুয়া প্রমাণ হয়েছে।
‘তদন্তের অগ্রগতিতে মনে হচ্ছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমিজমা সংক্রান্ত তাদের যে বিরোধ আছে, তাতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্যই তারা এই নাটক করে থাকতে পারেন।’
রহিমার নিখোঁজের পুরো ঘটনাটি তদন্ত করছেন পিবিআই খুলনার পরিদর্শক আবদুল মান্নান।
তিনি নিউজবাংলাকে জানান, আদালতে দেয়া রহিমার জবানবন্দির সত্যতা যাচাইয়ে মঙ্গলবার দিনভর ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘বোয়ালমারীতে রহিমা যে কথা বলেছেন, আদালতে সেইভাবে জবানবন্দি দেননি। সেখানে স্বামী ও মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছেন বলে জানিয়েছেন, যা জবানবন্দির সঙ্গে মিল নেই।’
আদালতে দেয়া জবানবন্দির নথিতে দেখা গেছে, রহিমা বলেছেন, ‘গত ২৭ আগস্ট পানি নেয়ার জন্য আমি বাসার নিচে আসি। এক বালতি নেয়ার পরে অন্য বালতি নিতে আসলে আসামিদের সঙ্গে আরও অনেক লোক আমার বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। তখন রাত ১০টা বাজে।
‘আসামি পলাশ ও মহিউদ্দিন কাপড় দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে। তখন আমার সঙ্গে থাকা মোবাইলও আসামিরা নিয়ে যায়। আসামিরা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার হুঁশ ফিরে আসলে তাকিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম লেখা। তারপর আমি রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনে ঢাকা আসি।
‘ঢাকা থেকে মুকসেদপুর আসি। সেখান থেকে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে আমার ভাড়াটিয়ার বাড়ি তথা কুদ্দুসদের বাড়ি যাই। তাদেরকে ঘটনা খুলে বলি। তাদের বাড়ি আমি ৮-৯ দিন ছিলাম। সেখান থেকে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে আসে। এই আমার জবানবন্দি।’
এ বিষয়ে পিবিআই পরিদর্শক আবদুল মান্নান বলেন, ‘জবনাবন্দিতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বলতে বান্দরবানকে বুঝিয়েছেন। আমরা জানি বান্দরবানে কোনো ট্রেনলাইন নেই।’
পিবিআইয়ের এসপি মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘রহিমা পুলিশকে বলেছেন যে হুঁশ ফিরে সাইনবোর্ড পড়ে তিনি দেখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম লেখা। ওই স্থানটি হলো বান্দরবান সদরের ইসলামপুর।
‘সেখানে তিনি মণি বেগমের ভাতের হোটেলে কাজ করেছেন। মণি বেগম তাকে স্থানীয় একটি ক্যাম্পে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। সে জন্য তার কাছে জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি কার্ড চাওয়া হয়েছিল। এগুলোর জন্য তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামে তার পূর্বপরিচিত কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান।
‘সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হকের কাছে গিয়ে জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি দাবি করেন। তবে সেখান থেকে তাকে জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি দেয়া হয়নি। পিবিআই বোয়ালমারী থেকে তদন্ত করে এসেছে। শিগগিরই বান্দরবানেও যাওয়া হবে।’
রহিমার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কারও ইন্ধন আছে কি না জানতে চাইলে পিবিআই পরিদর্শক আবদুল মান্নান বলেন, ‘রহিমাদের সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। বিষয়টি তার স্বামী ও সন্তানরাও জানতেন। তদন্ত শেষে মামলাটি ভুয়া প্রমাণ হলে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা মুক্তি পাবেন। তখন তারা চাইলে রহিমা ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।’
রহিমা নিখোঁজ হওয়ার পরদিন তাকে অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে দৌলতপুর থানায় মামলা করেছিলেন তার আরেক মেয়ে আদুরী আক্তার। তাতে আসামি করা হয়েছিল অজ্ঞাতনামাদের। তবে এজাহারে রহিমার সঙ্গে প্রতিবেশীদের জমির বিরোধের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। মরিয়মও মা নিখোঁজের পেছনে প্রতিবেশীদের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে।
এরপর তাদের পাঁচজন প্রতিবেশীকে গ্রেপ্তার করে। রহিমার দ্বিতীয় স্বামী বেল্লাল হাওলাদারকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে পরিদর্শক মান্নান বলেন, ‘পিবিআই প্রতিবেশী পাঁচজনকে সাতদিনের ও রহিমার স্বামী বেল্লালকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের জন্য আদালতে আবেদন করেছে। এখনও শুনানি হয়নি। বেল্লালকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। তখন বোঝা যাবে রহিমা আত্মগোপনের নেপথ্যে কারা জড়িত।’
পিবিআইয়ের এসপি মুশফিকুর বলেন, ‘আমাদের তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ তদন্তে যদি মরিয়ম ও তার পরিবার দোষী হয়, তবে আইন মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া মরিয়মদের মামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তদন্তে যদি তারা নির্দোষ হন, তবে তারাও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’
এসব বিষয়ে জানতে মরিয়ম, তার বোন আদুরী ও ভাই মিরাজ আল সাদীকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
তবে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মরিয়ম জানান, মায়ের অপহরণের বিষয়টি নিয়ে তারও এখন সন্দেহ হচ্ছে।
তিনি সেখানে বলেন, ‘কীভাবে বুঝব মা একা একা চলে গেছেন, আমাদের ছেড়ে, আর ফিরবেন না! জানলে কোনোদিন জিডি মামলায় যেতাম না। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আমার প্রথম মনে হয়েছে মা অপহরণ হননি। কারণ যখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করছিলেন কী হয়েছে, তিনি বলেছেন তাকে মেরেছে। এক বছর আগে তাকে যারা যেভাবে মেরেছিল সেই ব্যাখ্যা করছেন মা। মাকে দেখে ভয় পাচ্ছি। মা আমাকে অবিশ্বাস করছেন। এখন মিডিয়া বা কারও সামনে আসতে চান না। মায়ের যত্ন নেওয়াটা জরুরি।’