বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিংড়ায় বাড়িঘরে হামলা-লুটের পেছনে আ.লীগের দ্বন্দ্ব

  •    
  • ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৭:৫৯

ফেসবুকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীর পোস্ট ঘিরে সাম্প্রদায়িক হামলার গুঞ্জন উঠলেও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই তা নাকচ করেছে। বলেছে, বিগত উপজেলা ও ইউপি নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে বাড়িঘর ও দোকানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনা ঘটেছে।

নাটোরের সিংড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের। এটি কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা নয়। এই হামলার ভিকটিমরাও ক্ষমতাসীন দলটির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

অবশ্য আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আরিফা জেসমিন কণিকার ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক হামলার রূপ দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল।

সরেজমিন এলাকাবাসী, প্রশাসন ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিংড়া উপজেলার পাকুরিয়া গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাটির ভিকটিম কোনো সংখ্যালঘু পরিবার নয়। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে দুই ইউপি সদস্যের পূর্ববিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সোমবার বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এই হামলা-লুটপাটে নেতৃত্ব দেন সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেন ও ইটালী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম। আর তাকে মদদ দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম।

এ ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দীর্ঘ পোস্ট দেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকা। সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সহসভাপতি পোস্টে যোগ করেন, ‘এসব তথ্য সাংবাদিক ভাইদের নিকট থেকে প্রাপ্ত।’

ইউপি সদস্যের কার্যালয়েও হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। ছবি: নিউজবাংলা

কণিকা পোস্টে লেখেন-

‘নাটোরের সিংড়ায় ৩নং ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফের নেতৃত্বে পাকুরিয়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২টি বাড়ি ও ৬টি দোকানে ১৯৭১ ও ২০০১-এর মত ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মুক্তা ঠাকুর এবং মানিক ঠাকুরের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। লুটপাটের মালপত্র ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যায়।

‘গতকাল সোমবার বিকাল ৪টার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আরিফ চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে এ তাণ্ডব চালায় তার সমর্থকরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না।

‘গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই আরিফ চেয়ারম্যান ৭টি ইউনিয়নে ঘোড়া মার্কার বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছে। ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। প্রতিটি ইউনিয়নে তারা একইভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর দমন, নির্যাতন, নিপীড়ন চালাচ্ছে। দল এবং প্রশাসন এই সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মি।

‘নির্যাতিতদের ভাষ্যমতে, তারা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে আধ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সিংড়া থানা পুলিশ ফোন রিসিভ করেনি। লুটপাটের পর সন্ধ্যায় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ কথা বলারও সাহস পাচ্ছে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের কাছে আমি এই সন্ত্রাসীদের বিচার চাই।’

প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীর এই পোস্ট ঘিরে সিংড়ায় তোলপাড় শুরু হয়। সিংড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয় উল্লেখ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিন্দার ঝড় ওঠে।

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীর ফেসবুক পোস্টে তথ্যের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। আর তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতেও আঘাত করেছে।

এ প্রসঙ্গে আরিফা জেসমিন কণিকা বলেন, ‘স্থানীয়দের কাছে হামলার বিষয়টি শুনে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে বিচার চেয়েছি আমি। কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলিনি বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে তাও উল্লেখ করিনি।’

এ বিষয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। এটাকে কেউ কেউ ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।’

ফেসবুকে স্ত্রীর পোস্ট দেয়ার বিষয়ে পলক বলেন, ‘ফেসবুকের পোস্ট যার যার নিজস্ব বিষয়। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’

নাটোরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ছবি: নিউজবাংলা

এদিকে ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস ঘিরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরুর পর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান, নাটোর পৌরসভার মেয়র ও পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি উমা চৌধুরী জলি, সিংড়ার পৌর মেয়র মো. জান্নাতুল ফেরদৌস, সিংড়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জামিল আকতার, থানার ওসি নুর-ই-আলম সিদ্দিকীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

এ সময় জেলা প্রশাসক বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় দুই ইউপি সদস্যের পূর্ববিরোধের জের ধরে। মূলত ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকেই এটি ঘটেছে। কোনোক্রমেই সাম্প্রদায়িক কোনো হামলা নয়। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

পুলিশ সুপার বলেন, ‘জাহাঙ্গীর মেম্বার ও আলিফ মেম্বার এখানে ইলেকশন করেছেন। নির্বাচনে জাহাঙ্গীর নির্বাচিত হয়েছেন। তখন থেকেই তাদের বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি এখানে একটি মসজিদের ইমাম নিয়োগকে কেন্দ্র করে এ দুজনের মাঝে আবারও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। পরে আলিফ মেম্বার তার লোকজন নিয়ে জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়।

‘এ ঘটনায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা মামলা নিয়েছি। যারা এই অঘটন ঘটিয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে।’

এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সোমবার আলিফ হোসেন ও ইটালী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম তাদের কর্মী-সমর্থক নিয়ে পাকুরিয়া বাজারে এসে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের কার্যালয়, সাবেক ইউপি সদস্য ও ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তা লাল চক্রবর্তীর মার্কেট এবং অ্যাডভোকেট মানিক লাল চক্রবর্তী চেম্বারসহ ৮ থেকে ১০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। হামলাকারীরা পাকুরিয়া বাজারে দেশীয় অস্ত্র উঁচিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্থান ত্যাগ করে।

এ বিষয়ে মুক্তা লাল চক্রবর্তী বলেন, ‘বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করায় আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতা-কর্মীরা প্রতিনিয়ত হামলা-মামলার শিকার হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার হাইব্রিড আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকুরিয়া বাজারে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। তবে এটা কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা নয়।’

মুক্তা লাল চক্রবর্তীর বড় ভাই অ্যাডভোকেট মানিক লাল চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের সমর্থনে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ভোটে জয়ী হয়। এর পর থেকেই চেয়ারম্যান আরিফের সমর্থকরা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত। আর প্রতিপক্ষরা পরিকল্পিতভাবেই এই হামলা চালিয়েছে। আমার চেম্বার ভাঙচুর ও গুরুত্বপূর্ণ নথি লুটপাট করেছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেও সময়মতো সাহায্য পাইনি। তবে এটা কোনো সাম্প্রদায়িক ইস্যু নয়।’

বর্তমান ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। হামলাকারীরা বাজারে তাণ্ডব চালিয়েছে। আমার দলীয় কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত আলিফ হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘পূর্ববিরোধের জের ধরে ইটালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই।’

ইটালী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক পক্ষ থাকলে নাম আসবেই। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি বিচলিত নই।’

ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় আমি কোনোভাবেই জড়িত নই। প্রথম থেকেই ঘটনাটি সম্প্রদায়িক ইস্যুতে রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।

‘সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আরিফা জেসমিন কণিকার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। তিনি কেন যে আমাকে দেখতে পারেন না তা আমি নিজেও জানি না। ঘটনার সঠিক তদন্ত হোক তা আমিও চাই। দুই মেম্বারের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আমার জড়ানোর প্রশ্নই আসে না।’

সিংড়া থানার ওসি নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘এ ঘটনায় মুক্তা লাল চক্রবর্তী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাতজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২৫০ জনের নামে একটি মামলা করেছেন। মামলায় স্থানীয় ইটালী ইউপি চেয়ারম্যান আরিফ ও সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পর থেকেই অভিযুক্তরা পলাতক।’

এ বিভাগের আরো খবর