বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাধা উপেক্ষা করে স্রোতের মতো নৌকায় উঠেছিলেন পুণ্যার্থীরা

  •    
  • ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৩:১৭

প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারী নিরঞ্জন রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নৌকাটিতে অনেক লোক উঠতেছিল, কেউ কারো কথা শুনতেছিল না। অনেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে উঠতেছিল। একজন আরেকজনকে নিষেধ করতে করতে বহু লোক ওঠে। কাইও (কেউ) কারো কথা শোনেনাই। যখন নৌকাটা ছাড়ি দিছিল, তখন ডোবা ডোবা ভাব। সবাই ভয় পাইতেছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর পানির স্রোত শুরু হয়। ঢুলতে ঢুলতে নৌকাটা ডুবে যায়।’

পঞ্চগড়ের বোদায় করতোয়া নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকাডুবিতে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬১ জনের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এই দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন স্ত্রী-সন্তান, কেউ বাবা-মা; কেউ বা হারিয়েছেন পুরো পরিবার।

স্থানীয়রা বলছেন, এর আগে কোনো দুর্ঘটনায় একসঙ্গে এত লাশ দেখেননি এই জনপদের মানুষ। সারি সারি এমন লাশে পঞ্চগড়ের আকাশ ভারী হয়ে উঠছে।

তবে, এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য অসচেতনভাবে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠাকেই দায়ী করছেন নৌকার মাঝি ডিপজল ও ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বারসহ স্থানীয় প্রশাসন।

গত রোববার বেলা আড়াইটার দিকে আউলিয়া ঘাট থেকে বদেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার জন্য একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মানুষ হুড়োহুড়ি করে উঠতে থাকেন। সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিডিওতে দেখা যায়, ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় নৌকাটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিল। এ সময় অনেকেই নৌকাটিকে যেতে নিষেধ করছিলেন এবং কেউ কেউ ‘ডুবে যাবে’ বলেও চিৎকার করছিলেন। তবে সে চিৎকার আটকাতে পারেনি নৌকাটিকে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর অপর পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজা উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। সেদিন দুপুরের দিকে মূলত ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মালম্বীরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নদী পার হচ্ছিলেন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী নিউজবাংলাকে জানান, সেদিন নির্দিষ্ট ঘাট থেকে ২০০ গজ ভাটিতে নৌকায় যাত্রী তুলছিলেন মাঝি ডিপজল। সেসময় ঘাটে পুলিশ সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উপস্থিতি ছিলেন। হ্যান্ড মাইকে বার বার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পারাপারে নিষেধ করছিলেন তারা। পাড়ে থাকা অন্য লোকজনও তাদের নিষেধ করেন।

নৌকাটিতে যখন অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হচ্ছিল, তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত যাত্রীদের নৌকা থেকে নামতে বলা হচ্ছিল; কিন্তু সে নির্দেশনা কানে তোলেননি কেউ। কানায় কানায় পূর্ণ যাত্রীসহ ঝুঁকি নিয়েই নৌকাটি ছাড়েন মাঝি।

ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারী নিরঞ্জন রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নৌকাটা যখন মন্দিরের দিকে যাবে, তখন অনেক লোক উঠতেছিল, কেউ কারো কথা শুনতেছিল না। অনেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে উঠতেছিল। একজন আরেকজনকে নিষেধ করতে করতে বহু লোক ওঠে। কাইও (কেউ) কারো কথা শোনে নাই।’

তার বর্ণনায়, ‘যখন নৌকাটা ছাড়ি দিছিল, তখন ডোবা ডোবা ভাব। সবাই ভয় পাইতেছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর পানির স্রোত শুরু হয়। ঢুলতে ঢুলতে নৌকাটা ডুবে যায়। কেউ লাফ দিয়ে পানিত নামছে। কেউ চিৎকার দিছে, আর বলছে বাঁচাও বাঁচাও। আমরা কয়জনকে উদ্ধারও করছি।’

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামন হাট ইউনিয়নের বাসিন্দা মাহমুদুল হক। ওই সময় নদীতে মাছ ধরছিলেন তিনি।

নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আউলিয়া ঘাট থেকে বদেশ্বরী মন্দিরে যাওযার নৌকায় এত লোক ছিল যে, দাঁড়াবার জায়গা ছিল না। তখন পুলিশ বার বার নিষেধ করছে। ওখানে যারা ছিল তারাও নিষেধ করছে। কেউ কথা শোনে নাই। পুলিশের কথা শুনলে এত বড় ঘটনা ঘটত না।’

তিনি যোগ করেন, ‘একবার যায়া তো আবার আসি লোক নিতে পারিল হয় নৌকাটা। একবারে এত লোক ওঠার দরকার কী আছিল।’

রায়হান নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘যখন নৌকাটি ছাড়ে, তখন তো বহু লোক ছিল। সবাই আতংকে ছিল। হঠাৎ মাঝ নদীতে গিয়ে নৌকার যাত্রীরা চিল্লানো শুরু করে। এ সময় নৌকায় থাকা অনেকে যাত্রীদের নড়াচড়া না করতে বলেন। পর মুহূর্তেই নৌকাটি তলিয়ে যেতে শুরু করে।’

তার ভাষ্য, ‘ওই সময় অনেকে পাড়ে থাকা ছোট নৌকায় করে ১২ জনকে জীবিত এবং ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করে। মহিলা মানুষ সাঁতার না জানায় বেশি মারা গেছে, ছোট ছোট বাচ্চারাও মারা গেছে।

‘আমি জীবনে এতগুলো লোক মরা দেখি নাই, রাইতোত ঘুমাইতে পারি নাই’, যোগ করেন তিনি।

ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে কতজন যাত্রী ছিলেন সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে স্থানীয়দের দাবি, তবে ৫০ থেকে ৬০ জনের ধারণক্ষমতার হলেও নৌকাটিতে যাত্রী ছিল শতাধিক।

দুর্ঘটনাকবলিত নৌকার দৈর্ঘ্য ৩৪ হাত, প্রস্থ্য ১১ হাত। নৌকায় প্রতি এক হাত দূরত্বে একজন করে থাকলেও ৩৪ জন যাত্রী বহন করবে নৌকাটি। একটু চাপাচাপি করে যাত্রী তুললেও সংখ্যাটি ৫০ এর বেশি হওয়ার কথা নয়। সেখানে শতাধিক যাত্রী উঠে কীভাবে? প্রশ্নের জবাবে ইজারাদার জব্বার আলী বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজন দেখেছে। তাদের নিষেধ উপেক্ষা করে নৌকা ছাড়ার সময় হুরমুর করে যাত্রীরা নৌকায় উঠে পড়ে।’

বেঁচে ফেরা নৌকার মাঝি ডিপজলের বরাতে তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদূর যাওয়ার পর নৌকাটি টলমল করলে আবার পেছনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন মাঝি। সে সময় যাত্রীরা ভয়ে বেশি নড়াচড়া করলে কাত হয়ে নৌকাটি ডুবে যায়।’

জেলা পরিষদ থেকে এক বছরের জন্য আব্দুল জব্বারের নামে ইজারা দেয়া হয়েছে খেয়া ঘাটটি। অংশীদার রয়েছেন একাধিক। ঘাটে মোট চারটি নৌকা রয়েছে। দুইটি ঠেলা নৌকা ও দুইটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত। পারাপারে যাত্রী প্রতি ১০ টাকা করে নেয়া হয়।

আব্দুল জব্বার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অসাবধানতা ও অসচেতনার জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ ঘাটে নিরাপত্তা জোরদার ছিল না, এমনটাও দাবি করেছেন তিনি।

বেশি লাভের আশায় ইজারাদার ঘাটে যাত্রীর তুলনায় পর্যাপ্ত নৌকা ব্যবহার করেননি দাবি করে স্থানীয় বাবুল হোসেন। বলেন, ‘পূজার কারণে লোকজনের চাপ অনেক। তারা চারটি নৌকা ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু একটি ছোট নৌকা ও বড় নৌকা দিয়েই দিন পার করেন তারা। যাত্রীর তুলনায় নৌকা বেশি ছিল না। তাই সময়ের কথা চিন্তা করে মানুষ ঝুঁকি নিয়েছে। এজন্য এই সর্বনাশ হয়েছে।’

বোদা থাকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুজয় কুমার রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই ঘটটি ইজারা দেয়া। একটি ছোট আরেকটি বড় নৌকা ছিল। কিন্তু নৌকাটি আগের ঘাটে ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আপনি ভিডিও দেখলে বুঝতে পারবেন যে একজন চিৎকার করতেছে, সেই লোকটি আমাদের একজন এসআই। আমরা অনেক চেষ্টা করেও অতিরিক্ত লোক ওঠা বন্ধ করতে পারিনি। বেশি লোক ওঠায় এই দুর্ঘটনা।’

ঘটনাস্থলে থাকা মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আনসার মো রেজাউল করিম শামিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নৌকাটা মূল ঘাট থেকে ২০০ মিটার উজানে দাঁড়াইছে। আমরা মূল ঘাটে ছিলাম, প্রশাসনও ছিল। সেখানে লোক তুলছে, মানুষজন হুড়াহুড়ি করে উঠছে। আমরা দূর থেকে চিল্লাইছি লোক বেশি না উঠতে, কিন্তু শোনে নাই। তাছাড়া মাঝ নদী থেকে নৌকা ফিরতেছিল, কিন্তু তখন নৌকা ঘোরানোর সময় পানি ওঠে ডুবে গেছে।’

পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘নৌকার ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি লোক ছিল। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।’

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নৌকাডুবির ঘটনায় পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বীপংকর রায়কে প্রধান করে একটি ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর