বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ব্যবহৃত কাগজের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মক, নেই ভ্রুক্ষেপ

  •    
  • ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০৮:৪১

‘খবরের কাগজ/ছাপা কাগজ/লিখিত কাগজ এ ব্যবহৃত কালিতে ক্ষতিকর রং, পিগমেন্ট ও প্রিজারভেটিভস থাকে, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ছাড়া পুরোনো কাগজে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবও থাকে। খবরের কাগজ, ছাপা কাগজ/লিখিত কাগজ এর ঠোঙায় বা উক্ত কাগজে মোড়ানো খাদ্য নিয়মিত খেলে, মানবদেহে ক্যানসার, হৃদরোগ ও কিডনি রোগসহ নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হতে পারে।’

খোলা খাবার কেনাবেচার ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক একটি চিত্র। তবে এ যে স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর, সে বিষয়ে কারও যেন কোনো খেয়ালই নেই। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করছে এক দোকানে। বেচাকেনা হচ্ছে দেদার। কোনো ক্রেতা মুড়ি নিচ্ছেন প্লেটে, কেউ বা কাগজের মোড়কে। সেই মোড়ক তৈরি হয়েছে মূলত বইয়ের পাতা ব্যবহার করে।

সেই বইয়ের কাগজে এমন সব রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানুষের পেটে গেলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আবার মানুষের হাত থেকেও জীবাণু সংক্রমিত হয়েছে, সেটি বই পড়ার সময় আবার মোড়ক বানানোর সময়ও। কিন্তু না ক্রেতা, না বিক্রেতা, কারও মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে এতটুকু ভাবান্তর দেখা গেল না।

ঝালমুড়ি বিক্রেতা মাসুম মিয়া আসলে জানেনই না যে, এই কাগজ থেকে রোগ ছড়াতে পারে।

পাশেই খাজা বিক্রি করছিলেন এক নারী। তারও ধারণা ছিল না ব্যবহৃত কাগজে খাদ্য বিক্রির বিপদ সম্পর্কে। বিষয়টি বুঝিয়ে বললে তিনি বলেন, ‘এই কাগজে যে ক্ষতি অয় তা তো জানতামই না।’

এখন তো জানলেন, তাহলে কী করবেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এহন থেইকা প্লেটে দিমু।’

ওনার কাছ থেকেই খাজা কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন আনিস রহমান। তিনি বলেন, ‘জানি এগুলো ক্ষতিকর। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এভাবেই নেই। বাচ্চারা পছন্দ করে। তবে এরপর সতর্ক হব।’

ব্যবহৃত কাগজে খাবার দিচ্ছেন এক দোকানদার। ছবি: নিউজবাংলা

মোড়ে মোড়ে ঝালমুড়ি, ফুচকা, জিলাপি, পরোটা, পুরি, শিঙাড়া বা এই ধরনের খাবার পরিবেশন বা পরিবহনে যে মোড়কগুলো ব্যবহার করা হয়, তার সবই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে পলিথিনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা থাকলেও ব্যবহৃত কাগজের মোড়ক নিয়ে কারও মধ্যে ভাবান্তর নেই।

পরোটা পরিবহনের ক্ষেত্রে বিক্রেতারা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের পাশাপাশি প্রধানত খবরের কাগজ কেটে তা দিয়ে খাদ্যপণ্যটি মুড়িয়ে দেন। অনেক সময়ই দেখা যায় গরম পরোটায় কাগজের অক্ষর লেপ্টে গেছে।

এই বিষয়টি জানিয়ে যে কয়জন খাবার বিক্রেতার সঙ্গে নিউজবাংলা কথা বলেছে, তাদের সবাই প্রশ্ন তুলেছেন, যদি এভাবে খাবার দেয়া না যায়, তাহলে তারা আসলে কী করবেন।

তেজগাঁওয়েরই একটি খাবার হোটেলে কাগজে মুড়িয়ে মোগলাই পরোটা বিক্রি করছিলেন রায়হান। তিনিও বলেন, ‘এভাবেই বিক্রি করব। আর তো কিছু করার নাই।’

বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার ভূমিকাও একেবারেই দায়সারা গোছের। প্রায় এক দশক আগে করা আইনে এভাবে খাবার মোড়কজাত করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করা হলেও এর প্রচারেও নেই দৃশ্যমান উদ্যোগ।

তবে সম্প্রতি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভোক্তা এবং বিক্রেতাদের সাবধান করা হয়েছে। এই ব্যবহৃত কাগজের রং ও রাসায়নিক মানবস্বাস্থ্যের কী কী ক্ষতি করতে পারে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই ধরনের বিজ্ঞপ্তি কয়জন মানুষের হাতে পৌঁছে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

হোটেলে তৈরি হচ্ছে খাবার, পরিবেশন করা হচ্ছে ব্যবহৃত কাগজে। ছবি: নিউজবাংলা

কী ক্ষতি

পুরোনো কাগজ প্রধানত কেজি হিসেবে বিক্রি করা হয়। এরপর তা যায় মোড়ক তৈরির কারখানায়। সেখান থেকে তা আবার আসে বাজারে। এরপর কেজি বা শ হিসেবে তা কিনে নিয়ে আসা হয়। এই তৈরি ও পরিবহনের সময় এগুলোতে জীবাণুতে সংক্রমণ হতে পারে। এগুলো প্রিন্ট করার সময় যেসব রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বিপত্তি তো আছেই।

শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক এনামুল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন এই কাগজ প্রস্তুত হয়, এতে ক্লোরাইড, ডলোমাইড, হাইড্রোফ্লোরিস এসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, সোডিয়াম সালফেট থাকে। আবার এগুলোতে যখন ছাপার জন্য কালি ব্যবহার করা হয়, তাতে যে উপাদান যেমন ক্যাডমিয়াম, কপার, জিংক, রং, পিগমেন্ট ও প্রিজারভেটিভস থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া পুরোনো কাগজে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবও থাকে।’

তিনি বলেন, 'গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া হতে পারে। আবার এই কাগজগুলো যেসব জায়গা থেকে আসে সেখানেও জমে থাকতে পারে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু। তাই এগুলো পরিহার করা জরুরি।’

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘খবরের কাগজ/ছাপা কাগজ/লিখিত কাগজ এ ব্যবহৃত কালিতে ক্ষতিকর রং, পিগমেন্ট ও প্রিজারভেটিভস থাকে, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ছাড়া পুরোনো কাগজে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবও থাকে। খবরের কাগজ ছাপা কাগজ/লিখিত কাগজ এর ঠোঙায় বা উক্ত কাগজে মোড়ানো খাদ্য নিয়মিত খেলে, মানবদেহে ক্যানসার, হৃদরোগ ও কিডনিরোগসহ নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হতে পারে।’

করণীয় কী

এই প্রশ্নটাই আসলে সবচেয়ে জটিল, যার সঠিক এবং সহজ কোনো জবাব পাওয়া কঠিন।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিতে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পথ খাবার ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের খাদ্য স্পর্শক প্রবিধানমালা, ২০১৯ অনুসরণ করে পরিষ্কার ও নিরাপদ ফুডগ্রেড পাত্র ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে সেই বিধিমালায় স্পষ্ট করে কোন কোন পাত্র ব্যবহার করা উচিত, তার বর্ণনা নেই। মোড়কজাত পণ্যের ক্ষেত্রে কী করতে হবে, সেটিও এমন ভাষায় বর্ণনা করা, যার পাঠোদ্ধার করা সাধারণের পক্ষে কঠিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ খুরশিদুল জাহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব কাগজ ব্যবহার হয়, তা নোংরা জায়গা থেকে আসে। এতে জীবাণু সংক্রমিত হয়ে থাকে।’

তাহলে বিক্রেতারা কী ব্যবহার করবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ফ্রেশ (অব্যবহৃত) পেপার দিয়ে ব্যাগ তৈরি করা যায়, বা ফয়েল পেপার ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার বা রি ইউজেবল ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক ব্যবহার করা যেতে পারে।’

এসব খাবার পরিবেশনের ক্ষেত্রে ছোট ম্যালামাইন বা সিরামিকের পাত্র ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। সে ক্ষেত্রে পাত্রগুলো ব্যবহারের পরেই ধুয়ে ফেলার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

সাজা কঠোর

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পথ খাবার ব্যবসায়ীসহ অনেক খাদ্য ব্যবসায়ী খবরের কাগজ/ছাপা কাগজ/লিখিত কাগজ এর মাধ্যমে ঝালমুড়ি, ফুচকা, সমুচা, রোল, শিঙাড়া, পেঁয়াজি, জিলাপি, পরোটা ইত্যাদি পরিবেশন করছেন, যা নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জিসান মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই আইন অমান্য করলে ৩৩ ধারা অনুযায়ী সর্বনিম্ন এক বছর, সর্বোচ্চ তিন বছর, ন্যূনতম তিন লাখ টাকা ও অনূর্ধ্ব ৬ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’

দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা তিন বছর, জরিমানা ১২ লাখ টাকা অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে আইনে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সেই বিজ্ঞপ্তি

আইন প্রয়োগের উদাহরণ নেই

আইনটি করা হয়েছে ২০১৩ সালে। এর প্রয়োগের দৃষ্টান্ত নেই।

নয় বছর পর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়াটা সংস্থাটির অবহেলার প্রমাণ কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

নিউজবাংলা কর্তৃপক্ষের তিন জন কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কথা বলেননি কেউ।

প্রথমে যোগাযোগ করা হয় সদস্য (খাদ্য ভোগ ও ভোক্তা অধিকার) রেজাউল করিমের সঙ্গে। বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই বলতেই তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি সম্পৃক্ত না। এটা অন্যজন দেখে।’

সংস্থাটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উছেন মে ও আইন ও নীতি শাখার সদস্য শাহনওয়াজ দিলরুবা খানকে ফোন দিলে তারা দুই জনই চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন।

তবে চেয়ারম্যান আব্দুল কাইউম সরকারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

এ বিভাগের আরো খবর