পঞ্চগড়ের বোদায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ অর্ধশতাধিক। তাদের জীবিত পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে।
তবুও নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে করতোয়ার পাড়ে স্বজনদের অপেক্ষা। জীবিত না হোক, অন্তত মরদেহটি যদি মেলে।
এমনই দুর্বিষহ অপেক্ষায় রয়েছেন মাড়েয়া বটতলী এলাকার ধীরেন বাবু। নৌকাডুবিতে একজন, দুজন নয়; তার নিকটাত্মীয় ৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন। এই ৫ স্বজন ছাড়াও নিখোঁজ রয়েছেন তার আরও দুই প্রতিবেশী।
ধীরেন ধরেই নিয়েছেন তার নিখোঁজদের কেউ বেঁচে নেই। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে আমার ভাতিজা, ভাতিজার বউ, ভাতিজার শ্বশুর, শ্যালিকা এবং আমার ভাতিজি নৌকায় উঠে দুর্ঘটনায় পড়েন। এখন পর্যন্ত কারো খোঁজ পাইনি। এখন তাদের লাশের অপেক্ষা করতেছি।’
বোদা উপজেলার মারেয়া আউলিয়া-বদ্বেশ্বরী ঘাটে করতোয়া নদীতে রোববার দুপুরে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ডুবে যায়। যার বেশির ভাগই মহালয়ার পুণ্যার্থী ছিলেন। তারা নদীর ওপারে বদ্বেশ্বরী মন্দিরে প্রার্থনা শেষে ফিরছিলেন।
এ ঘটনায় কিছু যাত্রী বেঁচে ফিরতে পারলেও এখন পর্যন্ত নারী-শিশুসহ ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে; নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ৬০ জন।
সোমবার সকালে আউলিয়ার ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস এবং ডুবুরিদলের তিনটি ইউনিট উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেখানে নদীর পাড়ে ভিড় করছেন নিখোঁজদের স্বজনরা।
এর মধ্যে ভাই ও ভাইপোর খোঁজে ঘাটে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব কৃষ্ণ চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘নদীর অপর পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে আমার ভাই নরেশ ও ভাইপো সিন্টু বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। নৌকাডুবির খবরে খাল থেকেই এখানে লাশের অপেক্ষায় আছি।’
নাতির খোঁজে উপজেলার পাঁচপীর এলাকা থেকে এসেছেন বৃদ্ধ সুমল চন্দ্র। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নাতির মরদেহটা পেলে অন্তত নিজেরা সৎকারের কাজটা করতে পারতাম।’
রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করে ডুবুরিদল। সোমবার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত উদ্ধার হয় আরও সাত মরদেহ।
এর মধ্যে চারজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে পুলিশ। তারা হলেন পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার চামেশ্বরী গ্রামের শক্তিপদ রায়ের স্ত্রী ৫২ বছরের ঝর্ণা রানী, বোদা উপজেলার কাউয়াখাল গ্রামের সহিন রায়ের স্ত্রী ৪৫ বছরের সুমিত্রা রানী, একই উপজেলার বংশিধর পুজারী এলাকার বিমল রায়ের ৬ বছরের ছেলে সুর্য এবং ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বিশামতপাড়ার অনন্ত কুমারের স্ত্রী ৫২ বছরের পুস্পারানী।
প্রথম দিনে উদ্ধার হওয়া সব মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিন উদ্ধার হওয়া মরদেহ মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে মরদেহ স্বজনদের কাছে স্থানান্তর করা হবে।
নৌকায় ধারণক্ষমতার ‘দিগুণ’ যাত্রী ছিল
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর অপর পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজা উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। রোববার দুপুরের দিকে মূলত ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মালম্বীরা নৌকাযোগে নদী পার হচ্ছিলেন।
ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে কতজন যাত্রী ছিলেন সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে স্থানীয়দের দাবি, তবে ৫০ থেকে ৬০ জনের ধারণক্ষমতার হলেও নৌকাটিতে যাত্রী ছিল শতাধিক। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝপথে নৌকাটি ডুবে যায়। অনেকে সাঁতার জানায় তীরে আসতে পারলেও সাঁতার না জানা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পানিতে ডুবে যায়। মনে করা হচ্ছে, স্রোতের কারণে অনেক মরদেহ পানিতে ভেসে যেতে পারে।
নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী মাড়েয়া বামনপাড়া এলাকার সুবাস চন্দ্র রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমিও নৌকায় ছিলাম। নৌকায় শতাধিক যাত্রী ছিল। আমরা নৌকায় ওঠার পরপরই নৌকায় পানি ঢুকতে শুরু করে। এ সময় মানুষজন নৌকার মধ্যেই হুড়োহুড়ি শুরু করেন। পরে যে পাশেই যাচ্ছিলাম, সে পাশেই নৌকায় পানি ঢুকছিল।
‘আমরা পাঁচজন বন্ধু ছিলাম। কোনো মতে সাঁতার কেটে প্রাণে বেঁচে যাই। অন্য যাত্রীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি করছিল। তবে এত মানুষ মারা যাবে, তা বুঝতে পারিনি।’
এই প্রাণহানির জন্য জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলামও অতিরিক্ত যাত্রী বহনকে দায়ী করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। ঘটনাস্থলে মারওয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পুলিশ ছিল। তারা সবাই ওই নৌকায় এত লোক উঠতে নিষেধ করেছিলেন।
‘গতকাল বৃষ্টি হওয়ার কারণে নদীতে পানি বেশি ছিল, স্রোতও বেশি ছিল। নিষেধ করতে করতে সবাই উঠে যায়। যেহেতু ধর্মীয় বিষয় সবাই উঠতে চাইছিলেন। এরপর মাঝনদীতে গিয়ে ডুবে যায় নৌকাটি।’
সোমবার নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে। এ ঘটনায় একটি তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে।’