মহাসড়ক কিংবা সড়কের যত্রতত্র ভাগাড়। উটকো গন্ধে নাজেহাল পথচারী। রাজধানী ঢাকার কাছে সাভারের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের পাশে ময়লার স্তূপের দুর্ভোগ এখানকার নাগরিকদের এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। উটকো পচা গন্ধে নাভিশ্বাস উঠলেও অভিযোগ জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তারা।
কেন বছরের পর বছর ধরে সড়কের পাশে ময়লা ফেলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না– এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সাভারে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের চক্রবর্তী, শ্রীপুর, বাইপাইল, পলাশবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি স্থানে মূলত বাসাবাড়ির উচ্ছিষ্ট ময়লা দিন-রাত ছোট ছোট গাড়িতে করে এনে ফেলা হচ্ছে। মহল্লাভিত্তিক বাসাবাড়ি থেকে যারা ময়লা সংগ্রহ করেন, তারা বাসাপ্রতি ১০০ টাকা নিয়ে থাকেন। ছোট গাড়িতে করে তারা বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহ করে সড়কের পাশে এসব ভাগাড়ে ফেলেন। এ জন্য তাদের গাড়িপ্রতি গুনতে হয় চাঁদা। এসব ভাগাড় নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় শাহরিয়ার গার্মেন্টস নামক একটি পোশাক কারখানার বিপরীতে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে রয়েছে এ রকম একটি ভাগাড়। এখানে ময়লা ফেলতে গাড়িপ্রতি ৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করে একটি চক্র। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫টি গাড়ি এখানে ময়লা ফেলে। সে হিসাবে মাসে এই একটি স্পট থেকে প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা চলে যায় চাঁদাবাজদের পকেটে। বছরে সেই অঙ্কটা প্রায় ১ কোটি টাকা।
এ ছাড়া চক্রবর্তী, শ্রীপুর ও পলাশবাড়ীতে ময়লার স্পটগুলো থেকেও চাঁদাবাজির কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ময়লা বহনে জড়িত একাধিক ব্যক্তি। আর হকার্স লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সংশ্লিষ্টতার তথ্যও দিয়েছেন তারা।
বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহকারী মো. বাবুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাবলিকের কাছ থাইকে আমরা আগে নিছি ৬০ ট্যাকা রুমপ্রতি। এখন সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে ১০০ ট্যাকা কইরা নেই। ওহানে মাল ফালাইলে হ্যাগো কিছু ট্যাকা দেয়া লাগে। তিন গাড়ি মাল ফালাইলে ৫০০ ট্যাকা কইরা গাড়িপ্রতি মোট ১৫০০ ট্যাকা দেয়া লাগে। ওরা গাড়িপ্রতি ৫০০ ট্যাকা নেয় জুয়েল আর ওবায়দুল।’
এখন ময়লা ফেলানো বন্ধ আছে কি না- এমন প্রশ্নে বলেন, ‘না না, বন্ধ নাই। কোনো ঝামেলা নাই। ভোর ৬টা থাইকা শুরু কইরে মনে করেন সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মাল পড়ে। যত গাড়ি আপনে পারেন। ৪০ থেকে ৪৫টি গাড়ির ময়লা পড়ে।’
অভিযুক্ত আশুলিয়া থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মো. ওবায়দুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি ভাই আমারে দেহেন, আমারে পান, তহন আমারে ধইরা নিয়া যাইয়েন। আমার এলাকায় আমি ময়লা বহনের ব্যবসা করি। আমার একটা গাড়ি আছে। ওখানে বাধা দেয়ার পর আমার গাড়িগুলার ময়লা চক্রবর্তীতে পড়ে। আমি এটার মধ্যে জড়িত না ভাই। যারা নেয়, তাদের নামে নিউজ করেন। আমার কাছে আগে শরীফ নামের একজন নিত। আমি আগে মাসে ১১ হাজার ট্যাকা দিয়া ফালাইতাম। হকার্স লীগের ওই শরিফরে দিতাম। ঢাকা জেলা হকার্স লীগের আহ্বায়ক। ভাই, সত্য কথা, আমি আগে ফালাইতাম। এখন আর ফালাই না ভাই।’
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘জানি না। হয়তো যারা গাড়ির ময়লা ফালায়, আমার নাম দেয়। বিভিন্ন এলাকার আছে। আমার অবস্থান ভালো তো, হয়তো বা আমার নাম দিয়া বাঁইচা যায় আর কি। আমি আশুলিয়া থানা ছাত্রলীগের সাবেক কমিটির সহ-সভাপতি ছিলাম।’
মো. জুয়েল নামে আরেক অভিযুক্তের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে ঢাকা জেলা হকার্স লীগের আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম সবুজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এটার সঙ্গে জড়িত না। আমি এটার বিপক্ষে। আমি ওখানে শাহরিয়ার গার্মেন্টসের সিকিউরিটি গার্ডকে বইলা রাখছি, একটা গাড়ি এখানে যদি ফেলতে দেখ, আমারে ফোন দিবা, আমি আসুম।’
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল আপনাকে টাকা দিয়ে এখানে ময়লা ফেলেছে- এমন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘না না, ওবায়দুল নামের কাউকে চিনি না তো। যদি আমার নাম কেউ বলে থাকে, আমাকে ফোন দিবেন।’
মানিকগঞ্জ সড়ক ও জনপদ বিভাগের নয়ারহাট শাখার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাখার প্রকৌশলী আরাফাত সাকলায়েন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি পুরোটা পরিষ্কার করেছি। পরিষ্কার করে ময়লাগুলো ঠেলে দিয়ে একটা ব্যানার দিছি বড়। আমাকে এলাকার লোকজন ফোন দিছিল। পাশাপাশি আমি জিডির কাগজ পৌঁছাইছি পুলিশের কাছে। পুলিশ এখনও জিডি করে নাই। ওনারা নাকি এখন সরেজমিনে পরিদর্শন করে জিডি করেন। আমি লোক পাঠায় জিডিটা এনসিওর করাব।’
টাকার বিনিময়ে ওখানে ময়লা ফেলানো হচ্ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা ওই জায়গায় একটি বড় ড্রেন করি। বাস যেন দাঁড়াতে পারে- এ রকম একটা কিছু করতে চাচ্ছি। যেহেতু জায়গাটা আমাদের হাত থেকে ছুটেই যাচ্ছে। ওরা বার বার ময়লা ফালাচ্ছে, এই করতেছে, সেই করতেছে। একটা পার্মানেন্ট সলুশন চাচ্ছি আর কি।’
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক দিন আগে ওই স্থানটি বেদখল হয়ে যাচ্ছে বলে আমাদের অবগত করা হয়েছিল। তবে জিডি বা অভিযোগ দায়ের হয়নি। নতুন করে ময়লার ভাগাড় থেকে চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’