খুলনা মহেশ্বরপাশা থেকে নিখোঁজ রহিমা বেগম দাবি করছেন, তিনি অপহৃত হয়েছিলেন। তবে মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষ পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, প্রাথমিক আলামতে মনে হচ্ছে এই দাবি সঠিক নয়। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
রহিমা বেগমকে শনিবার অক্ষত অবস্থায় ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মায়ের নিখোঁজের তথ্য জানিয়ে প্রায় এক মাস ধরে তার সন্ধান করছিলেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। মরিয়মের কান্নার ছবি ছুঁয়ে যায় সবাইকে।
বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় রহিমা বেগমকে। কুদ্দুস মোল্লার স্বজনদের দাবি, রহিমা তাদের বলেছিলেন সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেশী ও মেয়েদের সঙ্গে তার বিরোধ চলছিল। এ কারণেই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
ফরিদপুর থেকে উদ্ধারের পর থেকে নিশ্চুপ ছিলেন রহিমা বেগম। খুলনার সোনাডাঙ্গায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রোববার সকালে মরিয়ম মান্নানসহ অন্য সন্তানরা দেখা করতে গেলেও তাদের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।
পুলিশের অনুরোধে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের জানালার কাছে এসে দাঁড়ান রহিমা বেগম। মরিয়ম মান্নান এ সময় ‘মা’ বলে ডাক দিলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হেঁটে চলে যান।
তবে দুপুরের পরে মরিয়মসহ অন্য মেয়েরা পিবিআই কার্যালয়ে এসে রহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন রহিমা।
খুলনা পিবিআই কার্যালয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করেন মরিয়ম ও তার বোনেরাদৌলতপুর থানার উপপরিদর্শক দোলা দে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকা অবস্থায় তার (রহিমা) মেয়েরা দেখা করতে এসেছিল। তবে তিনি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। পরে আমার অনুরোধে জানালার কাছে এসেছিলেন। মরিয়ম মা বলে ডাক দিলে আবার ভেতরে চলে যান। পরে তাকে আমরা পিবিআই খুলনা জেলা কার্যালয়ে হস্তান্তর করি।
‘পিবিআই কার্যালয়েও তাকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রথম দিকে তিনি একেবারে নিশ্চুপ ছিলেন।’
খুলনা পিবিআই পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নানাভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তবে কোনোভাবেই তিনি মুখ খুলতে চাননি।
‘তবে দুপুরের পর তার মেয়ে মরিয়মসহ অন্যরা পিবিআই কার্যালয়ে এসে রহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন রহিমা বেগম।’
সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘মেয়েদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর রহিমা বেগম মুখ খুলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিবেশী কিবরিয়া ও মহিউদ্দীনসহ তিনজন তাকে অপহরণ করেছিল। তাকে কোথাও আটকে রেখে ব্ল্যাংক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। পরে ১ হাজার টাকা দিয়ে তাকে ছেড়ে দেন।’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘রহিমা বেগমের দাবি, তিনি কিছুই চিনতে পারছিলেন না। ছাড়া পাওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম ও বান্দরবান যান। পরে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর হয়ে পূর্বপরিচিত ভাড়াটিয়ার ফরিদপুরের বোয়ালখালী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে যান। তার কাছে কোনো মোবাইল নাম্বার না থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।’
রহিমা বেগম যাদের বিরুদ্ধে জোর করে স্ট্যাম্পে সই নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন সেই গোলাম কিবরিয়া, মহিউদ্দীনসহ চারজনকে ৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ৩০ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় হেলাল শরীফ নামে আরেকজনকে। সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বর রহিমার স্বামী বিল্লাল ঘটককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা সবাই কারাগারে আছেন।
রহিমার দাবি সত্যি হলে, ২৭ আগস্ট তিনি অপহৃত হওয়ার পর ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কিবরিয়া ও মহিউদ্দীনরা তার কাছ থেকে স্ট্যাম্পে সই নিয়ে ছেড়ে দেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম, বান্দরবান, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালখালী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান।
শনিবার রাতে ফরিদপুর থেকে উদ্ধারের পর খুলনায় নেয়া হয় রহিমাকে। ছবি: নিউজবাংলাঅপহরণকারীদের দেয়া মাত্র ১ হাজার টাকায় অন্তত ১৩ দিন তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় কীভাবে কাটালেন সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে পিবিআই।
রহিমা অপহৃত হওয়ার অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রহিমা বেগমকে উদ্ধারের সময়ে তার কাছ থেকে একটি সাদা ব্যাগ পাওয়া গেছে। তাতে ওষুধ ছিল, পোশাকসহ অন্য মালামাল ছিল। একজন ব্যক্তি অপহরণ হলে তার সঙ্গে এগুলো থাকতে পারে না। তাই এটা অপহরণ নাও হতে পারে।
‘আমরা রহিমা বেগমের বক্তব্য খতিয়ে দেখছি। অনেক রহস্য রয়ে গেছে। তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আইন অনুযায়ী তদন্ত শেষে সবকিছু প্রকাশ করা হবে।’
যে বাড়ি থেকে উদ্ধার তারা যা বলছেন
ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় রহিমা বেগমকে।
কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে জয়নাল ব্যাপারীর দাবি, তিনি শুক্রবার রাতেই রহিমার অবস্থানের তথ্য মরিয়ম মান্নানের পরিবারকে জানিয়েও কোনো সাড়া পাননি।
জয়নাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে শুক্রবার বিকেলে যমুনা টিভিতে তার নিখোঁজ সংবাদ দেখি। রহিমার সঙ্গে মিল দেখে আমি বাড়িতে গিয়ে তার চেহারার সঙ্গে মেলাই, দেখি উনিই সেই জন।
“রহিমা বেগমকে ভিডিও দেখালে শুধু বলে ‘এটা তো আমি’। তখন তাকে খোঁজা হচ্ছে জানালে সে বলে ‘আমি বাড়ি ফিরে যাব না।”
জয়নাল বলেন, ‘এরপর আমি যমুনা টিভির ভিডিওতে কমেন্ট করি। সেখানে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার সার্চ দিতে থাকি। তখন নিখোঁজ বার্তায় তার ছেলে মিরাজের নম্বর পাই। শুক্রবার রাতে মিরাজের নম্বরে কল দিলে তার স্ত্রী ফোন ধরে।
“আমি তাকে বলি রহিমা বেগম এখানে আছে। তখন অপর পাশ থেকে উত্তর আসে ‘আমি ওনাকে চিনি না। এ নম্বরে আর ফোন দেবেন না’। এই বলে সে ফোন কেটে দেয়।”
জয়নাল বলেন, ‘তার ছেলে–মেয়ে তাকে (রহিমা) কেউ পছন্দ করে না। তিনি বাড়িতে ফিরে যাবেন না। তিনি বাড়ি গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে বলেও জানান রহিমা বেগম। তারা বাড়ি বিক্রি করতে চাপ দিচ্ছিল। বাড়ি বেচার টাকা নিয়ে অন্যত্র চলে যাবে। তিনি তাতে রাজি নন।’
বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার এই বাড়িতে ছিলেন রহিমা। ছবি: নিউজবাংলাকুদ্দুস মোল্লার বড় মেয়ের জামাই নূর মোহাম্মদের দাবি, সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেশী ও মেয়েদের সঙ্গে রহিমার বিরোধ চলছিল। এ কারণেই তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন।
নূর মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রহিমা বেগম আমাদের এখানে এসে বলেছিলেন আমাকে একটা কাজ খুঁজে দেন, আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। যেকোনো কাজ, ইটভাটার হোক, জুট মিলের হোক বা বাসাবাড়ির হোক।
‘আমার মেয়েদের সঙ্গে আমার শত্রুতা, মেয়েরা আমাকে ভালো জানে না, তারা আমাকে চায় না, আমার সম্পত্তি চায়। প্রতিবেশীও আমার সম্পত্তি চায়।’
কুদ্দুস মোল্লার প্রতিবেশীদেরও একই কথা বলেছেন রহিমা বেগম।
নূর মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে জানান, রহিমা বেগম ১৭ সেপ্টেম্বর তাদের বাড়িতে আসেন।
তিনি বলেন, ‘ওইদিন বিকেলে রহিমা বেগম সৈয়দপুর বাজারে আসেন। তিনি অনেক দোকানে কুদ্দুস মোল্লার বাবা মোতালেব মুসল্লির বাড়ি খুঁজছিলেন। এই বাজারেই আমার দোকান আছে। এক দোকানদার আমার দাদা শ্বশুরকে খুঁজছে দেখে আমার কাছে নিয়ে আসে।
‘আমি তাকে বাড়িতে পাঠাই। বাড়ি গিয়ে আমার শাশুড়ি প্রথমে চিনতে পারছিলেন না। মরিয়মের মা তখন বলতে থাকেন, খুলনায় আমার বাড়িতে আপনারা ভাড়া ছিলেন, আমি মিরাজের মা, হুজুরের বউ। তখন চিনতে পেরে তাকে ভেতরে নিয়ে যান। সে বলেছিল, আমি বেড়াতে আসছি, দুই-তিন দিন থাকব। আমরা অতিথি ভেবে স্বাভাবিক আচরণ করেছি।’
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এর মধ্যে তিনি (রহিমা) দুই বার বোয়ালমারী সদর হাসপাতালে গেছেন চোখ দেখাতে। একদিন গেছেন ইউনিয়ন কার্যালয়ে। তিনি বাইরে গিয়ে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতেন কি না বা বা টাকা কোথা থেকে পেতেন সেটা বলতে পারছি না।’
প্রতিবেশী স্থানীয় মেম্বার মোশারফ হোসেন মূসা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শনিবার সকালে জয়নাল আমাকে রহিমা বেগমের নিখোঁজের বিষয়টি জানায়। তখন আমি খুলনা সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলামকে অবগত করি। আমি একটা সালিশে গিয়েছিলাম তার অফিসে। তিনি মিটিংয়ে ছিলেন জানিয়ে পরে কথা বলবেন বলেন।
‘পরে বিকেল ৫টার দিকে তিনি আমাকে কল দেন। বলেন, এ রকম একটা ঘটনা আছে। কাউন্সিলর বলেন আপনি ওই নারীকে দেখে রাখেন, আমরা আসব। এর মধ্যেই রাত ১০টার দিকে আমাকে ফোন করে লোকেশন জানতে চান, সাড়ে ১০টার দিকে তারা উপস্থিত হন। পরে খুলনা পুলিশ বোয়ালমারী থানাকে ইনফর্ম করে তাকে (রহিমা) খুলনা নিয়ে যান।’