ময়মনসিংহের ফুলপুরে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর মরদেহকে নিজের মা দাবি করে শনিবারও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন দেশজুড়ে আলোচিত মরিয়ম মান্নান। অথচ তার মা রহিমা বেগম ফরিদপুরে যাদের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন তাদেরই এক আত্মীয় শুক্রবার মরিয়মের পরিবারে ফোন করে রহিমার অবস্থানের বিষয়ে তথ্য দেন।
জবাবে রহিমা নামের কাউকে চেনেন না বলে ফোন কেটে দেন মরিয়মের ভাই মিরাজ আল সাদীর স্ত্রী।
খুলনার মহেশ্বরপাশা থেকে নিখোঁজ রহিমা বেগমকে শনিবার অক্ষত অবস্থায় ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মায়ের নিখোঁজের তথ্য জানিয়ে প্রায় এক মাস ধরে তার সন্ধান করছিলেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। মরিয়মের কান্নার ছবি ছুঁয়ে যায় সবাইকে।
বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় রহিমা বেগমকে।
ময়মনসিংহে অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহকে মায়ের দাবি করে শনিবারও স্ট্যাটাস দেন মরিয়মরহিমাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তোলপাড়ের মধ্যে শুক্রবার এ বিষয়ে জানতে পারেন কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে জয়নাল ব্যাপারী।
জয়নাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে শুক্রবার বিকেলে যমুনা টিভিতে তার নিখোঁজ সংবাদ দেখি। রহিমার সঙ্গে মিল দেখে আমি বাড়িতে গিয়ে তার চেহারারা সঙ্গে মিলাই, দেখি উনিই সেই জন।
“রহিমা বেগমকে ভিডিও দেখালে শুধু বলে 'এটা তো আমি'। তখন তাকে খোঁজা হচ্ছে জানালে সে বলে 'আমি বাড়ি ফিরে যাব না।“
জয়নাল বলেন, ‘এরপর আমি যমুনা টিভির ভিডিওতে কমেন্ট করি। সেখানে কোনো উত্তর না পেয়ে আর সার্চ দিতে থাকি। তখন নিখোঁজ বার্তায় তার ছেলে মিরাজের নম্বর পাই। শুক্রবার রাতে মিরাজের নম্বরে কল দিলে তার স্ত্রী ফোন ধরে।
“আমি তাকে বলি রহিমা বেগম এখানে আছে। তখন অপর পাশ থেকে উত্তর আসে 'আমি ওনাকে চিনি না। এ নম্বরে আর ফোন দেবেন না'। এই বলে সে ফোন কেটে দেয়।“
কুদ্দুস মোল্লার বড় মেয়ের জামাই নূর মোহাম্মদের দাবি, সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেশী ও মেয়েদের সঙ্গে রহিমার বিরোধ চলছিল। এ কারণেই তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন।
ফরিদপুর থেকে খুলনা আনার পর মরিয়মের মা রহিমা বেগমনূর মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রহিমা বেগম আমাদের এখানে এসে বলেছিলেন আমাকে একটা কাজ খুঁজে দেন, আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। যেকোনো কাজ, ইটভাটার হোক, জুট মিলের হোক বা বাসাবাড়ির হোক।
‘আমার মেয়েদের সঙ্গে আমার শত্রুতা, মেয়েরা আমাকে ভালো জানে না, তারা আমাকে চায় না, আমার সম্পত্তি চায়। প্রতিবেশীও আমার সম্পত্তি চায়।’
কুদ্দুস মোল্লার প্রতিবেশীদেরও একই কথা বলেছেন রহিমা বেগম।
নূর মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে জানান, রহিমা বেগম ১৭ সেপ্টেম্বর তাদের বাড়িতে আসেন।
তিনি বলেন, ‘ওই দিন বিকেলে রহিমা বেগম সৈয়দপুর বাজারে আসেন। তিনি অনেক দোকানে কুদ্দুস মোল্লার বাবা মোতালেব মুসল্লির বাড়ি খুঁজছিলেন। এই বাজারেই আমার দোকান আছে। এক দোকানদার আমার দাদা শ্বশুরকে খুঁজছে দেখে আমার কাছে নিয়ে আসে।
‘আমি তাকে বাড়িতে পাঠাই। বাড়ি গিয়ে আমার শাশুড়ি প্রথমে চিনতে পারছিলেন না। মরিয়মের মা তখন বলতে থাকেন, খুলনায় আমার বাড়িতে আপনারা ভাড়া ছিলেন, আমি মিরাজের মা, হুজুরের বউ। তখন চিনতে পেরে তাকে ভেতরে নিয়ে যান। সে বলেছিল, আমি বেড়াতে আসছি, দুই-তিন দিন থাকব। আমরা অতিথি ভেবে স্বাভাবিক আচরণ করেছি।’
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এর মধ্যে তিনি (রহিমা) দুই বার বোয়ালমারী সদর হাসপাতালে গেছেন চোখ দেখাতে। একদিন গেছেন ইউনিয়ন কার্যালয়ে। তিনি বাইরে গিয়ে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতেন কি না বা বা টাকা কোথা থেকে পেতেন সেটা বলতে পারছি না।’
প্রতিবেশী স্থানীয় মেম্বার মোশারফ হোসেন মূসা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শনিবার সকালে জয়নাল আমাকে রহিমা বেগমের নিখোঁজের বিষয়টি জানায়। তখন আমি খুলনা সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলামকে অবগত করি। আমি একটা সালিশে গিয়েছিলাম তার অফিসে। তিনি মিটিংয়ে ছিলেন জানিয়ে পরে কথা বলবেন বলেন।
‘পরে বিকেল ৫টার দিকে তিনি আমাকে কল দেন। বলেন, এ রকম একটা ঘটনা আছে। কাউন্সিলর বলেন আপনি ওই নারীকে দেখে রাখেন, আমরা আসব। এর মধ্যেই রাত ১০টার দিকে আমাকে ফোন করে লোকেশন জানতে চান, সাড়ে ১০টার দিকে তারা উপস্থিত হন। পরে খুলনা পুলিশ বোয়ালমারী থানাকে ইনফর্ম করে তাকে (রহিমা) খুলনা নিয়ে যান।’
মরিয়ম মান্নানের কান্নার ছবি ভাইরাল হয় ফেসবুকেরহিমার অবস্থানের তথ্য জানিয়ে জয়নাল ব্যাপারীর ফোন করার বিষয়ে জানতে চাইলে তার ছেলে মিরাজ নিউজবাংলার কাছে দাবি করেন, সেদিন রাতে তার দুটি ফোনই ছিল বোন মরিয়ম মান্নানের কাছে।
তিনি বলেন, ‘আমার ফোন কখনই স্ত্রীর কাছে থাকে না। শুক্রবার সারা দিন প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে ক্লান্ত হয়ে বিকেলের পর ঘুমিয়ে পড়ি। এরপর আমার দুটি ফোনই ছিল মরিয়মের কাছে। সে সময় কেউ ফোন করে বোনকে মায়ের বিষয়ে তথ্য দিয়েছিল কি না সেটি আমার জানা নেই।’
অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহকে নিজের মায়ের দাবি করে বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন মরিয়ম মান্নান। পরদিন মরিয়মসহ তিন বোন ময়মনসিংহের ফুলপুর থানায় যান।
ফুলপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মোতালেব চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে থানায় তারা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় তিন বোনকে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের ছবি, পরনের গোলাপি রঙের সালোয়ার; গায়ে সুতির ছাপা গোলাপি, কালো-বেগুনি ও কমলা রঙের কামিজ এবং গোলাপি রঙের ওড়না দেখায় পুলিশ।’
নিহত নারীর বয়স ২৮ থেকে ৩০ বছর। এ কারণে পুলিশ মরিয়মকে জানায়, মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষা লাগকে। এরপর মরিয়ম মান্নান নিজের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার আবেদন করেন।
শুক্রবার বিকেলে ফুলপুর উপজেলা থেকে চলে যান মরিয়মরা৷ পরদিন শনিবার সকালে মরিয়মের ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন আদালতে জমা দেয় পুলিশ। শনিবার সকালেও ফেসবুক স্ট্যাটাসে মরিয়ম দাবি করেন, ফুলপুরে পাওয়া মরদেহটি তার মায়েরই।