বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সংসার গোছানোয় ব্যস্ত নিখিল-শান্তনা

  •    
  • ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:০৫

১০১ বই দেনমোহরে বিয়ে করা বগুড়ার সেই আলোচিত দম্পতির সংসার কেমন চলছে দেখতে ঢুঁ মারেন নিউজবাংলার প্রতিনিধি। 

বিয়ে করে সপ্তাহ এখনও পেরোয়নি। নতুন সংসারে গোছগাছ বাকি। শুধু দুটি ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন বর-বধূ। টুকিটাকি অনেক জিনিসের দরকার। ১০১টি বই দেনমোহরানায় বিয়ে করে দেশজুড়ে আলোচিত নবদম্পতি নিখিল-শান্তনা এখন সংসার সাজাতে ব্যস্ত।

ব্যস্ততার ফাঁকে বুধবার বিকেলে একটু সময় চেয়ে নেয়া হয়েছিল তাদের। কথামতো যাওয়া হয় শহরের খান্দার এলাকায়। সবে দুপুরের খাওয়া শেষ করেন তারা। হাসিমুখে প্রতিবেদককে অভিবাদনের সঙ্গে বিকেলে টিউশনির কথাও জানালেন শান্তনা খাতুন।

হাসতে হাসতে নিখিল বলেন, ‘আমাদের বিয়েটা হওয়ার কথা ছিল সাদামাটা, অনেকটা গোপনে। কিন্তু আপনারা তো সব গোমর ফাঁস করে দিলেন। এখন পথে-ঘাটে দেখামাত্র সবাই বলে ওঠে: আপনিই বই দিয়ে বিয়ে করা সেই ব্যক্তি।’

দুজনের প্রেম বেশি দিনের নয়। এ বছরের জানুয়ারিতে শান্তনার প্রিয় এক শিক্ষকের জন্য একটি লেখা ফেসবুকে পোস্ট করেন নিখিল নওশাদ। সেই লেখা দেখে ফেসবুকে পরিচয়। তবে তখনই সাক্ষাৎ করেননি তারা। মাসখানেক পর দুজনের দেখা হয়। দিনটি ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি। এরপর আলাপ আরও জমতে থাকে। দুজনেই সাহিত্য-অন্তপ্রাণ, তাই মনের মিথষ্ক্রিয়া বাড়তে সময় লাগেনি মোটেও। একসময় উপলব্ধি করেন একসঙ্গে থাকতে হবে। সংসার বাঁধবেন তারা।

নিখিল বলেন, ‘১৬ তারিখকে প্রতীক হিসেবে রাখতে চেয়েছিলাম আমরা। এ জন্য বিয়ে করেছি ১৬ সেপ্টেম্বর। অন্য কোনো মাস হলেও তারিখ এটাই থাকত। বইয়ের বিষয়টি শান্তনার আগে থেকেই পরিকল্পনা। আমি না হয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করলেও সে এমনটাই চাইত।’

এসব কথার মাঝে শান্তনা এ-ঘর ও-ঘরে টুকিটাকি সাংসারিক কাজও করছিলেন।

কথার রেশ ধরে শান্তনা বলেন, ‘আসলে নিখিল সবে চাকরিতে এসেছে। ওর আয় থেকে এখনও এমন কোনো সঞ্চয় হয়নি যে কনেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে।

‘মেয়েদের স্বামীর সামর্থ্য বুঝে ওই অর্থ দাবি করা উচিত। আমার প্রয়োজন ছিল বই। তার সাধ্যের মধ্যে সেই বই সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী করলে তার কাছেও বই চাইতাম। এই বই সারা জীবনের জন্য থেকে যাবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সেটি কাজে লাগবে।’

এর মাঝেই জানা গেল নিখিল একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। বেশ কিছুদিন গাইবান্ধায় কাজ করেছেন। এখন বগুড়ায়। আর শান্তনা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করে এ বছরের ৩১ জানুয়ারি শহরের উত্তর চেলোপাড়া দাখিল মাদ্রাসার ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

মাদ্রাসার বিষয় আসতেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। কথা শুনেই আবার হাসলেন দুজনে।

শান্তনা বললেন, ‘এখানেও তো আপনারা ভাইরাল করে দিয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এমন ঘটনায় আনন্দিত। তাদের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছিলাম। কেন বিয়ের দাওয়াত দেইনি– এই একটাই অভিযোগ। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের আরও একটি কৌতূহল ছিল, দেনমোহরের বইগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ের বই ছিল কি না।'

শান্তনা বলেন, ‘আমার তালিকায় সব ধরনের বই রাখা হয়েছে। মাদ্রাসায় তারা যেহেতু ধর্মপ্রাণ, এ জন্য তারা ওই প্রশ্ন করেছিলেন। হাদিস, ধর্মীয় নিয়ম-কানুনের বই কেনা হয়েছে শোনার পর তারা খুশি।’

শিক্ষার্থীদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত শান্তনা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজির পাঠদান করান তিনি। অল্প কয়েক দিনে তাদের প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। বিয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ছিল নানা প্রশ্ন, আর আফসোস। বিয়েতে তাদের উপস্থিত থাকার খুব ইচ্ছা ছিল।

তার ভাষায়, ‘স্কুল ও মাদ্রাসার একই কারিকুলাম। কিন্তু মাদ্রাসায় আরবি বিষয়ে পড়ার চাপ একটু বেশি থাকে। ফলে স্বভাবতই শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে সময় কম দেয়। কিন্তু আমি তাদের ইংরেজি বিষয়টি পড়াই গল্পের ছলে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ওদের সঙ্গে গল্প হয়। আর তাদের সব প্রশ্নের জবাব দেই।

‘মাদ্রাসায় জয়েন করার পরপরই তাদের মন থেকে ইংরেজির ভীতিটা দূর করার চেষ্টা করেছি। এ জন্য এখন দেখা যায় আমার শ্রেণিকক্ষে ঢোকার আগেই তারা বই খুলে বসে থাকে।’

এসব কথার মাঝে জানা গেল দুজনেই পড়াশোনা করেছেন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে। শান্তনা সোনাতলা উপজেলার কামালেরপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ে। নিখিলের বাড়ি বগুড়ার ধুনটের গোসাইবাড়ী। শান্তনার পরিবারে মা, বাবা ও এক বোন রয়েছে। নিখিলের পরিবার একটু বড়। মা, বাবা, নিখিলসহ তিন ভাই ও তিন বোন।

শান্তনার পরিবারে তিনিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট মেয়ে। তাই একটু বড় হওয়ার পর থেকেই লাইব্রেরি গড়া, পড়ার অভ্যাস রাখার জন্য কিছু করার স্বপ্ন ছিল। সেটা থেকেই বই সংগ্রহের ইচ্ছার জন্ম নেয় তার।

শান্তনা বলেন, ‘বই আগে থেকে পড়তাম। কিন্তু আজিজুল হক কলেজে ইংরেজিতে ভর্তি হওয়ার পর সাহিত্যের রস বুঝতে শুরু করি।’

এ দম্পতি জানান, দেনমোহরের এখনও প্রায় ৩০টি বই সংগ্রহের বাকি আছে। সেগুলো সময় নিয়েই কিনবেন। সংগ্রহের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু লেখকের বই রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়। এ ছাড়া আইরিশ ও আফ্রিকান সাহিত্যের কিছু বই রাখবেন তারা।

এরপর পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন দুজনে। ঘরটি প্রায় ফাঁকা। পূব দিকে একটি জানালা। একধারে কিছু রান্নার সরঞ্জাম। জানালেন, এখানেই বইগুলো সাজিয়ে রাখবেন। আর পুবালী জানালার নিচে একটি চৌকি খাট বসানো হবে। মাঝেমধ্যে সেই খাটে হেলান দিয়ে বসে বই পড়বেন তারা। আপাতত বইগুলো শান্তনার বাবার বাড়িতে আছে। আর কিছুদিন পর নিয়ে আসবেন।

এ নবদম্পতি নিজেদের আরেকটি অভিজ্ঞতা জানান, খ্যাতির বিড়ম্বনা! নিখিল বলেন, ‘যখন বিয়ের জন্য কাজী পাচ্ছিলাম না, তখনও অনেকের ফোনে প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছিল। এক ভাই তো রাত দেড়টায় ফোন দিয়েছিলেন ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। বিয়ের পর অনেকে বইয়ের তালিকা চেয়ে ফোন দিচ্ছেন, বলছেন তারা বই দিতে আগ্রহী।’

শান্তনা বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনদের কাছে জবাবদিহিতে পড়েছি। তখন খুব খারাপ লেগেছিল। আর সত্যি কথা বলতে কী, আমরা নিজেদের প্রাইভেসিটাও পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এটাও ঠিক নিউজ হওয়ায় এ ঘটনাটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। এটি একটি ইতিবাচক বিষয়। এ জন্য আমরাও বিড়ম্বনা মেনে নিয়েছি।’

আলাপ ফুরায় না, সময়ও বসে থাকে না। ঘড়িতে ৫টা পার হয়ে যায়। সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিমে। টিউশনিতে যেতে হবে। শান্তনা আবদার করলেন নিখিলকে, এগিয়ে দিতে। জানালা-দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লেন দুজনে। এতটুকু পথের আলাপেও তাদের জড়িয়ে রয় কবিতা। ভালো থাকুক কাব্যপ্রেমীরা।

এ বিভাগের আরো খবর