বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সশস্ত্র মিছিল ও হামলায় ছাত্রলীগ, মামলা বিএনপির বিরুদ্ধে

  •    
  • ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৭:৫৪

গত ১৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় ছাত্রলীগের মিছিলে রামদা, কুড়াল, লোহার পাইপসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্লোগান দেয়া হয়। পরে হামলা হয় বিএনপি ও ছাত্রদল নেতাদের বাড়িতে। আগের রাতে ছাত্রদলের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো তাদের পক্ষ থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

ফেসবুকে সয়লাব, জাতীয় গণমাধ্যমেও এসেছে বড় বড় ছবি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অস্ত্র হাতে মিছিল করা ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই পুলিশের। তাদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেনি- এমন যুক্তি দেখিয়ে পুরোপুরি নির্বিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি।

সশস্ত্র ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা না নিলেও তারা যাদের ওপর হামলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেই ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই মামলার বাদী ছাত্রলীগের এক নেতা। আর বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতারা মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি।

যা ঘটেছিল

গত ১৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ ডাকে বিএনপি। রূপগঞ্জে যেন বিএনপি ও ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ করতে না পারে, সে জন্য সকাল থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান হাইওয়ে (বাইপাস) সড়কের অন্তত ৩০টি স্থানে অবস্থান নিয়ে মিছিল করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা। চলে মোটরসাইকেলের মহড়াও।

দুপুরে ভুলতা এলাকায় উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাজমুল হাসান সবুজের নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে।

এতে দেখা যায়, রামদা, কুড়াল, লোহার পাইপসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্লোগান দিচ্ছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই মিছিল থেকে বারবার স্লোগান দেয়া হয় ‘বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ আছে এক সাথে।’

সেদিন স্লোগান দিচ্ছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাজমুল হাসান সবুজ নিজেই। তার পাশেই বড় একটি ছোরা হাতে নিয়ে মিছিলের সঙ্গে এগিয়ে যান রাশেদুল নামে এক কর্মী। একই সারিতে হেলমেট পরে রামদা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন আরেক কর্মী ইয়াসিন। চাইনিজ কুড়াল উঁচু করে স্লোগান দিচ্ছিলেন সজিব ও অন্য আরেকজন, যার নাম জানা যায়নি।

সে রাতেই উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতিকে মারধর করা হয়। হামলা হয় তার এবং বিএনপির আরও দুই কর্মীর বাড়িতে।

চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিএনপির সভাপতি হারুন মিজি বলেন, ‘স্থানীয় ইউপি সদস্য বজলুর রহমান বজলু অস্ত্রশস্ত্রসহ বিএনপি কর্মী হযরত আলী, ইউসুফ আলীর বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। মারধর করা হয় ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি মাসুমকে।’

পুলিশ নির্বিকার

এ ঘটনার পাঁচ দিন পার হয়ে গেলেও পুলিশ আটক করার চেষ্টা করেনি কোনো অস্ত্রধারীকে।

তাদের ব্যাপারে কেন নির্বিকার পুলিশ- জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে কেউ থানায় অভিযোগ দেয়নি। এ কারণে তাদের নামে মামলা হয়নি। মামলা না হলে তো ধরা যায় না।’

তবে রামদা, কুড়াল নিয়ে মিছিলের চিত্র দেখেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা, সেটি তিনি বলেছেন নিজেই।

যদি দেখেই থাকেন, তাহলে ধরছেন না কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যদি তাদের ওই দেশীয় অস্ত্রসহ হাতেনাতে ধরা যেত তাহলে তাদের পুলিশ আটক করত। তবুও বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। আশা করি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বলেই কি রামদা, কুড়াল নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল করার পরও ছাড় দেয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই প্রশ্ন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে করা প্রয়োজন।’

পরে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসপি গোলাম মোস্তাফা রাসেলের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে নিউজবাংলা। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।

তবে সশস্ত্র মিছিলের পরের দিন তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘যারা রামদা, কুড়াল নিয়ে মহড়া চালিয়েছে তাদের সন্ধান করা হচ্ছে। থানা পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঘটনার তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে।’

ফোন ধরেননি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু।

গত রোববারের সশস্ত্র মিছিলে থাকলেও তাদের কাউকে চেনেন না বলে দাবি করেছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাজমুল হাসান সবুজ।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যাদের হাতে এগুলো ছিল, আমি তাদের চিনি না। এরা কারা জানি না। আমি সন্ত্রাস করি না।’

আপনারা কেন সেখানে গিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিএনপির লোকজন যেন জ্বালাও-পোড়াও করতে না পারে এ জন্য আমরা ভুলতায় ছিলাম। অন্য নেতা-কর্মীরা আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন এলাকা দখলে রাখে।’

বিএনপির বিরুদ্ধে মামলায় ‘হ্যাঁ’, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মামলায় ‘না’

সেই সশস্ত্র মিছিলের আগের দিন রাজধানীতে তাবিথ আওয়ালসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বলাইখা এলাকায় ছাত্রদল নেতা মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে মশাল মিছিল করেন নেতা-কর্মীরা।

মিছিলটি মহাসড়কের বলাইখা থেকে ভুলতা বাসস্টেশনের দিকে গেলে সেখানে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা বাধা দেয়। এরপর হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।

এর জেরে রাত ১০টার দিকে মাসুদুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ককটেলের। মারধর করা হয় ছাত্রদল নেতার বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের। এ ঘটনায় মাসুদুর রহমানের মামলা নেয়নি পুলিশ।

তবে সোমবার জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমানসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত দেড় শ বিএনপি সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলা হয় রূপগঞ্জ থানায়।

ভুলতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হানিফ মিয়া মামলায় উল্লেখ করেছেন, ‘শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে ওই ১০ জনসহ অজ্ঞাত প্রায় দেড় শ লোক লাঠিসোঁটা, ককটেল, পিস্তল, রামদা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আউখাব অনুপম গার্মেন্টের সামনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মশাল মিছিল বের করে টায়ারে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা দুজনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে। পরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে চলে যায়।’

তবে এই ঘটনায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি দাবি করেন থানায় গেলেও মামলা নেয়নি।

তবে বেশি রভাগ ঘটনার পর থানায় যায় না নেতা-কর্মীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, থানায় গেলেই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের খোঁজে মহড়া চালানো হয়।

জেলা বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘জেলা যুবদলের আহ্বায়ক খোকনের বাড়িতে অসংখ্যবার হামলা হয়েছে। গুলি ছোড়া হয়েছে। আমরা থানায় গেছি। অভিযোগ করেছি কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। আদালতে মামলার আবেদন করলে থানাকে তদন্ত দেয়। থানা পুলিশ জানিয়ে দেয় এমন ঘটনাই নাকি ঘটেনি।’

রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাহাফুজুর রহমান হুমায়ুন বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর-লুটপাট চালানো হচ্ছে। আহত করা হচ্ছে নেতা-কর্মীসহ পরিবারের সদস্যদের। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা না হলে আগামীতে কঠোর জবাব দেয়া হবে।’

সশস্ত্র মহড়া কেবল সেদিনই নয়

স্থানীয়রা জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রাজনীতির আধিপত্য ধরে রাখতে একের পর এক হামলা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া চালিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। গত এক মাসে এমন ঘটনা রয়েছে অন্তত ১০টি স্থানে। কিন্তু মামলা হয়নি একটি ঘটনায়ও।

এই সময়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত ১৪ জন নেতা-কর্মীর বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মারধর করা হয়েছে অনেক নেতা-কর্মী এবং তাদের স্বজনদের।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, গোলাকান্দাইলের যুবদল নেতা ওমর হোসেনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কায়েতপাড়ায় ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি, কাঞ্চন পৌর বিএনপির তিন নেতার বাড়ি, জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতির বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সর্বশেষ চনপাড়ায় তিন নেতা-কর্মীরা বাড়িতে হামলা ও মারধর করা হয়।

ফোন ধরেননি মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি

অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ নেতারা যার নামে স্লোগান দিচ্ছিলেন, তিনি হলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, যিনি রূপগঞ্জ আসন থেকে টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তার ব্যক্তিগত সহকারী এমদাদ হোসেনকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

রূপগঞ্জের সামগ্রিক চিত্র নিয়ে পাওয়া অভিযোগ সম্পর্কে জানালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করি না। যদি এমনটা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা জেলা আওয়ামী লীগ তার তদন্ত করব।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূইয়া বলেন, ‘কারা ছাত্রলীগের সভাপতি, সেক্রেটারি আমি তো তাই জানি না। যারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনায় বসছি। ’

হামলার বিষয়ে পুলিশ যা বলছে

বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলার বিষয়ে এক প্রশ্নে পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল তিন দিন আগে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি নেতা-কর্মীরা থানায় এসে অভিযোগ দেয় না। তারা যে ঘটনা বলে ঘটনাস্থলে গেলে তার উল্টো পাওয়া যায়।’

এসব ঘটনার বিষয়ে জানতে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি এ এফ এম সায়েদের মুঠোফোনে অন্তত আটবার ফোন করা হয়, তবে তিনি ফোন ধরেননি।

এই পুলিশ কর্মকর্তার ফোন না ধরা কোনো নতুন ঘটনা নয়। সচরাচর সাংবাদিকদের কল তিনি এড়িয়ে চলেন। ঘটনাচক্রে কোনো দিন ধরলেও বলে থাকেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর