জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এজন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তিশালী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে একটি হাই-লেভেল সাইড ইভেন্টে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান।
এতদিনে একজন রোহিঙ্গারও প্রত্যাবর্তন না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গত মাসে আমরা দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটের ষষ্ঠ বছরে পা দিয়েছি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই এই সংকটের একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। বৈঠকেও তিনি তা পুর্নব্যক্ত করেন।
নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমান সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে এবং সেখানেই এর সমাধান রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পদ্ধতিগতভাবে বাদ দেয়া এবং নির্বিচার নিপীড়নের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার ১৯৬০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
‘আজকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া জোরপূর্বক বিতাড়িত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা ১২ লাখ এবং ক্যাম্পে প্রতিদিন নতুন নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে।’
শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুরু থেকেই বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে। ২০১৭ সালে গণ হারে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে দুই দেশ তিনটি চুক্তি সই করেছিল।
‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুটি প্রচেষ্টাও চালানো হয়। কিন্তু রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় বাছাই করা সেসব রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি ছিল না। নিরাপত্তা, সহিংসতার পুনরাবৃত্তি না হওয়া, জীবিকার সুযোগ এবং নাগরিকত্বের পথসহ মৌলিক অধিকারের ইস্যুগুলো নিয়ে রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন ছিল বলেই তারা ফিরতে চায়নি।’
তিনি বলেন, ‘অব্যাহতভাবে মিয়ানমার তার অঙ্গীকার অমান্য করায়, ত্রিপক্ষীয় একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চীনের সহায়তায় প্রত্যাবর্তন আলোচনা শুরুর জন্য বাংলাদেশ বিকল্পের আশ্রয় নেয়। তবে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।’
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এবং প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না। সংকট সমাধানে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘বাংলাদেশ মনে করে- রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।’
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থার শক্তিশালী ভূমিকার আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যে কোনো উদ্যোগকে সমর্থন করবে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ এবং আসিয়ানের বর্তমান ফোকাস মিয়ানমারে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা- মিয়ানমারের জনগণের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং নিজেদের জন্মভূমিতে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এই সংস্থাগুলোর শক্তিশালী ভূমিকার অপেক্ষা করছে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের শক্ত ভূমিকা প্রত্যাশা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আসিয়ান প্রধান ভূমিকা নিতে পারে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতে রাখাইন রাজ্যের ওপর কফি আনান উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশগুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রচেষ্টা নেয়া উচিত। বেসামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের অর্থবহ উপস্থিতি স্বেচ্ছায় নিজের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনে রোহিঙ্গাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।’
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ৫টি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেগুলো হলো-
১. রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে সমর্থন করা;
২. আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়াকে সমর্থন করা; আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতের কার্যক্রমে সহায়তা করা।
৩. জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
৪. আসিয়ানের পাঁচ-দফা ঐকমত্যের অধীনে মিয়ানমারকে তাদের প্রতিশ্রুতি দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে বলা।
৫. বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকারের জন্য মিয়ানমার যাতে সম্মত হয় সেই প্রচেষ্টা চালানো।
ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অষ্টম শতাব্দী থেকে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করছে, যা এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার যখন স্বাধীন হয়, নতুন সরকার কোন কোন জাতিসত্তা নাগরিকত্ব পেতে পারে তা সংজ্ঞায়িত করে নাগরিকত্ব আইন পাস করে।
‘এতে রোহিঙ্গাদের ভিন্ন জাতির বহিরাগত হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে। তারপর ১৯৮২ সালে নতুন একটি নাগরিকত্ব আইন পাস করা হয়েছিল, যেটি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে থাকা ১৩৫ জাতি-গোষ্ঠীর একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৫২ সালে যখন ইউ নু রাষ্ট্রপতি হন, তিনি তার মন্ত্রিসভায় দুজন মুসলিম রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করেন- বাণিজ্য ও উন্নয়নমন্ত্রী হিসাবে ইউ রশিদ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে সুলতান মাহমুদকে। তার পার্লামেন্টে আব্দুল বাশার, জোহরা বেগম, আবুল খায়ের, আবদুস সোবহান, রশিদ আহমেদ, নাসিরুদ্দিন এবং দুইজন সংসদীয় সচিব, সুলতান আহমেদ এবং আব্দুল গাফফার নামে ছয়জন মুসলিম রোহিঙ্গা ছিলেন।
‘এটি প্রমাণ করে যে মুসলিম রোহিঙ্গরা এখনও মিয়ানমারের নাগরিক এবং একজন নাগরিক হিসেবে মুসলিম রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মন্ত্রিসভা ও সংসদে থাকতে পারে।’