মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থেকে ২০০ গজ ভেতরে তুমব্রু শ্রীশ্রী দুর্গা মন্দির। পাশেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭টি পরিবারের বসবাস। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে প্রতি বছর এই মন্দিরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন স্থানীয়রা।
কিন্তু মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর এক মাস ধরে চলা সংঘর্ষ এবার পূজা আয়োজনে কালো ছায়া ফেলেছে। এই মন্দিরে দুর্গাপূজা আয়োজন নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে।
শ্রীশ্রী দুর্গা মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি রূপলা ধর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক মাস ধরে সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যে পরিমাণ গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা যাচ্ছে তেমনটা অতীতে হয়নি। এ অবস্থায় আসন্ন দুর্গাপূজা আয়োজন নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে।’
রূপলা ধর আরও বলেন, ‘ডিসি, এসপি ও ইউএনও মহোদয় ডেকেছিলেন। তাদের পরিস্থিতি জানিয়েছি। তারা পূজার স্থান অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অর্ধশত বছর ধরে এই মন্দিরে আয়োজন হওয়া এ উৎসব অন্যত্র সরাতে এলাকার লোকজনও তেমন একটা রাজি না। তার পরও প্রশাসনের অনুমতি না মিললে আমরা পূজার আয়োজন করব না।’
স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য আনোয়ারা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু বর্ডার পরিস্থিতির কারণে এবার তাদের উৎসব নিয়ে চিন্তা বেড়েছে। তবে প্রশাসনের অনুমতি না মিললে এখানে পূজার আয়োজন করাটা উচিত হবে না।’
মন্দিরের পাশেই সুগন্ধা কর্মকারের বাড়ি। স্বামী-সন্তান নিয়ে মন্দিরের সামনে এসে নবনির্মিত প্রতিমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছেন। কয়েক যুগ ধরে চলে আসা তাদের এই উৎসব নিয়ে চলছে নানা দ্বিধা-বিভক্তি। শেষ পর্যন্ত এই মন্দিরে পূজা হবে কি না জানেন না সুগন্ধা।
তিনি বলেন, ‘বড় করে না হোক। ছোট পরিসরে হলেও যেন এখানে পূজা করতে দেয়া হয়। কারণ সন্তানদের জন্য কেনাকাটা করা হয়েছে। যে বাজেট ছিল তা খরচও করেছি। এতকিছুর পর যদি উৎসব করতে না পারি তাহলে তা কীভাবে মেনে নেয়া যায়!’
তুমব্রু বাজারের পেছনের বাসিন্দা সুমিতা রায় বলেন, ‘৫০ বছর ধরে আমাদের বাবা-দাদারাও এখানে পূজা করে এসেছেন। কোভিড পরিস্থিতিতেও ছোট পরিসরে এখানে পূজা হয়েছে। এবার একেবারে করতে না পারলে তা হবে হতাশাজনক। তবে প্রশাসনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। তারা অনুমতি দিলে আমরা এখানে পূজার আয়োজন করব।’
আরেক বাসিন্দা প্রদীপ ধর বলেন, ‘দেড় শতাধিক মানুষের একমাত্র উৎসবের কেন্দ্র এই মন্দির। অন্যত্র পূজা করতে হলে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এ মন্দিরে পূজা আয়োজনের উদ্দেশ্যে আমরা প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে ইতোমধ্যে সবকিছু কিনে ফেলেছি।’
১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু বাজার শ্রীশ্রী দুর্গা মন্দির। তার পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭টি পরিবারের দেড় শতাধিক মানুষের বসবাস এই মন্দির ঘিরে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে প্রতি বছর তারা এখানে পূজার আয়োজন করে আসছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পূজা আয়োজনের সময় মিয়ানমার থেকে কোনো গোলা এসে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই পূজা আয়োজনের স্থান অন্যত্র নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে সীমিত পরিসরে এই মন্দিরে পূজা আয়োজনের বিষয়টি আমরা ভেবে দেখব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভিন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি আমরা এখনও নজরদারিতে রেখেছি। তুমব্রু সীমান্তের মন্দিরে দুর্গাপূজা উদযাপন নিয়ে বৈঠকেই আছি। এখান থেকে বেরিয়ে বিস্তারিত বলতে পারব।
বৃহস্পতিবারও ৫০ গোলার শব্দ
এদিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলে সীমান্তের শূন্যরেখায় এক রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার ঘটনার পর তুমব্রু সীমান্তে আরও তীব্রভাবে গোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অন্তত ৫০টি গোলার শব্দ ভেসে এসেছে তুমব্রুর পশ্চিমকূল, উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায়। এমন অবস্থায় চরম আতঙ্কে আছে এই এলাকার মানুষ।
প্রায় এক মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল, গোলাগুলিসহ নানা ভারী অস্ত্রের আওয়াজে এপারে ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু ও বাইশপারী এলাকার মানুষ দিন কাটাচ্ছে আতঙ্কে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টার শেল বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের ভূখণ্ডেও এসে পড়েছে।
সর্বশেষ শুক্রবার রাতে তুমব্রুর কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুবক নিহত হন। আহত হন রোহিঙ্গা শিশুসহ পাঁচজন।
একই দিন দুপুরে এই সীমান্তেই হেডম্যানপাড়ার ৩৫ নম্বর পিলারের ৩০০ মিটার মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন বাংলাদেশি এক যুবক।
২৮ আগস্ট তুমব্রু উত্তরপাড়ায় একটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। সেদিনই সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানকে চক্কর দিতে দেখা যায়। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এসে পড়ে। সেগুলো অবিস্ফোরিত থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর তিন দিন পর পুনরায় ওই সীমান্তে ভারী অস্ত্র থেকে গোলা ছোড়ার শব্দ ভেসে আসে।